মেঘসন্ধ্যার আকাশ

6 জুন

সুজন সুপান্থ

মেঘসন্ধ্যার আকাশ

১.
তখন ঘন মঙ্গাআঁধার। খাঁ খাঁ উনুন। লাকরি আছে, হাড়ি আছে তবুও জ্বলেনি চুলা। জমি আছে, শস্য নেই। গোলাঘর আছে, চাল নেই। আমাদের মুখে মুখে হাসি আছে, আনন্দ নেই। আমরা সবাই পাশাপাশি ঘর, তবু দূরত্ব অসীম। মা আছে, মায়ের শাড়ির সেই ঘ্রাণটুকু আছে। শুধু শাড়ির আঁচলে বাঁধা আদর মাখানো কোনো খাবার নেই। এ রকম একটা ঘোর অন্ধকারের ভেতর দিয়ে অনেকটা দিন পেরিয়ে যেতে যেতে আমরা বড় হয়ে উঠি। একটু বড় হলেই কাউকে বলা বারণ, আজ দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি তেমন। বরং ঠোঁটে হালকা করে সরিষার তেল মেখে ঘুরে বেড়িয়েছি এ পাড়া ও পাড়া, কার্তিকদের বাড়ি। সবাই জেনেছিল, দুপুরে মোরগ-পোলাও খেয়ে ঠোঁটে তার চিহ্ন নিয়ে ঘুরছি। আর ভেবেছি—একদিন কার্তিকদের মতো শাকের অম্বল দিয়ে পেটপুরে ভাত খেয়ে কাঁইয়্যার বিলে রঙিন ঘুড়ি ওড়াতে যাবো।

২.
ঘুড়ি ওড়ানোর বাসনা দমিয়ে রোজ বিকেল বেলা পুকুর পাড়ে খেজুর গাছের আড়ালে নির্জনে বসে থাকলে বিনুদি কীভাবে যেন টের পেয়ে যেত। বিনু’দি পাড়াতেই থাকতো। স্কুল বন্ধু। তবু বিনু’দি আমার থেকে বড়, যতটুকু ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীর দূরত্ব। সকাল বেলা টিফিনের টাকার জেদে স্কুল না যাওয়ার হুমকি দিলে, দূরত্ব পেরিয়ে এসে বিনুদি হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যেত। যেতে যেতে বলত, ‘কান্দিস না, মুই (আমি) তোক (তোমাকে) ঝালমুড়ি কিনি (কিনে) দিম (দেবো)।’ আর অমনি, বিনুদির হাত ঝুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাথার ভেতর গুল জাফরের দোকানের ক্যাসেটে বেজে ওঠা গানের সুর ঢুকে যায়—হাওয়া মে উড়তা যায়ে, মোরা লাল দোপাট্টা মাল মাল।

তারপর ষষ্ঠ শ্রেনী ছুটি হয়ে গেলে নবম শ্রেণীর বেঞ্চে বিনু’দির পাশে চুপটি মেরে বসা। ঝালমুড়ি খেতে খেতে এক সময় বানানের সুরে বেঞ্চের ওপর খোদাই করা লেখা পড়ি—বিনু+সোম (সোমনাথ)। এই সুর কানে পৌঁছানো মাত্র মুখ চেপে ধরে কাছে টেনে নেয় বিনু’দি। তখন এই যোগ চিহ্নের মাজেজা বোঝা হয়নি অতটা। তবুও কেন যেন ইচ্ছে করত—নিজের নামের পরে যোগ চিহ্ন দিয়ে লিখে রাখি ‘বিনু’দি’। ভাবতে ভাবতে ঘণ্টা বাজে। ছুটি হয় নবম শ্রেণী। বাড়ি ফিরি হাঁটতে হাঁটতে, বাড়ি ফেরে পার্শ্ববর্তীনি। প্যান্টের পকেটে মুঠো করে ধরে রাখি যোগ চিহ্নের খেয়াল।

তো যা বলছিলাম, পেটে খিদে নিয়ে বিকেলে পুকুর পাড়ে নির্জনে বসে থাকলে বিনু’দি ঠিক ঠিক ধরে ফেলত। বুঝতো খাওয়া হয়নি। ওর অবশ্য ঠোঁটে সরিষার তেল মাখতে হত না। এতে তাদের কোনো আক্ষেপ ছিল না কোনোদিন। কী খেয়েছিস আজ, এই প্রশ্নের উত্তর দিই, পানি। অমনি বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে বিনু’দি। তারপর প্যান্টের কোচড় থেকে দুটো ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া পোড়া আলু বের করে বলে—আয় খাই। আমরা ক্ষুধা পেটে আলুপোড়া খাই; আর ঘুড়ির বদলে পুকুরের জলে উড়ে আসা বাতাসে দুটো ছায়ার পাশাপাশি এক হওয়া দেখি। ছায়া দুটো পুকুরের জলে ডুবে গেলে এক সাথে বাড়ি ফিরে আসি। এক সাথে ফিরি, তবু আমাদের বাড়ি, টিনের চাল, রাত্রিবেলার ঘর আলাদা সুরে বাজে। এই সুর নিয়ে অনেকটা রাত যেন মাতালের রাত। একবার এমন মাতাল রাতে ইকোনো কলমের খোঁচায় পর্দা সরিয়ে টেবিলের একদম মাঝে লিখে রাখি পুরনো খেয়াল—সোমনাথ নয়, আমার ডাকনামের পাশে বড় একটা যোগচিহ্ন তারপর বিনু’দির নাম। কলমের কালি পরে পরে সেই নাম কালো হয়ে যায়। চুপিচুপি রোজ এই দৃশ্য দেখে, কালো নাম ঢেকে রাখি হলুদ পর্দায়…

৩.
এত যে মঙ্গাআঁধার, তবুও বাড়ির সামনে ছিল সৌখিন ফুলের বাহার। পুরো বাগানজুড়ে শুধু বাবা-মায়ের পায়ের ছাপচিহ্ন। বাগানের প্রতিটি ফুল, ফুলে মধু নিতে আসা প্রতিটি প্রজাপতিও হয়তো বাবা-মাকে চিনে ফেলেছিল।
বাগানের প্রসঙ্গ এলে কেবলই বি নু দি র নামের বানান ভেসে ওঠে। সিঁদুর বিনু’দির খুব পছন্দ ছিল। বলতো, একদিন সিঁথিতে সিঁদুর মেখে বহুদূরে অন্য কোনো এক বাগানের দিকে চলে যাবে। সেখানে বিনুদি ফুলফুল খেলবে। আমি তাকে ‘না’ বলি। মন খারাপ করে থাকি, শব্দহীন। বিনু’দি কাতুকুতু দেয়, হাসি না। বাগান থেকে রক্তজবা তুলে বিনু’দির সিঁথিতে তার রঙ মেখে দিই। লাল হয়ে যায় সিঁথিপথ। এই লাল নিয়ে তাকে ধরে রাখতে চাই। বিনুদি খিলখিল হেসে ওঠে। তার হাসির শব্দ বুকের ভেতরে তীরের ফলার মতো এসে লাগে।

৪.
একদিন মেঘলা আকাশ। সেইদিন সন্ধ্যার আগে, পুকুর পাড়ে বাঁশপাতা দিয়ে নৌকা বানাতে বানাতে বিনু’দি বলেছিল, তুই কোথা থেকে এসেছিস জানিস নাকি! এদিকে মৌনস্বর, জানি না তো অতো। সেই সন্ধ্যায় বলেছিল—বাগান থেকে রে বোকা, বাগান থেকে। প্রজাপতির মতো সেই বাগানে ঢুকে কেউ ফুলফুল খেলে। জিতে গেলে খসে পড়ে ফুল। সেই ফুল অসীম আদরে বেড়ে বেড়ে আজ তুই এই ছটু। সেই বাগান দেখার বড় সাধ জাগে। সাধের পাশাপাশি আরও নাম না জানা কী যেন একটা জেগে ওঠে। আমার কেমন কেমন যেন লাগে। বাঁশপাতার নৌকা পুকুরে ছেড়ে দিয়ে কাশবনের দিকে যেতে যেতে বিনু’দি বাগান দেখাতে চায়। চঞ্চল হয়ে উঠি। হঠাৎ বিনু’দি পুকুরে লাফিয়ে ওপাড়ে চলে যায়। খিলখিল হাসতে হাসতে বলে, যদি সাঁতার দিয়ে কাছে যেতে পারি, তবেই ঘুরে আসা যাবে সেই বাগানের ঘ্রাণ। পারিনি। শুধু ঢেউয়ের তালে তালে বাঁশপাতা নৌকার চলে যাওয়া দেখেছি। তখনও সাঁতার শিখিনি আমি, এখন যেমন…অদেখাই থেকে গেল গোপন বাগান…

৫.
সেই রাতে বাড়ি ফিরে ভর করেছিল কী এক বিষণ্নতা! রাফখাতাজুড়ে কাটাকুটি আঁকি। আঁকি সেই মন খারাপের মেঘসন্ধ্যার আকাশ। অথচ আঁকতে গিয়ে প্রতিবারই মেঘলা আকাশটা কেন যেন বিনু’দির বুকের মতো গোল গোল হয়ে ওঠে। আমার অসহ্য লাগে। অভিমান জাগে।

৬.
এতকিছুর পরও বুকের ভেতর থেকে বিনু’দিকে দিই সকালের ফুল, বিকেল বেলার হাসি। রোজ দিই রক্তজবার সিঁদুর। তবু একদিন সকালবেলার বকুল ফুল হাতে নিয়ে শুনি বিনু’দি নেই। নেই মানে, সেই যে সোমনাথ, তার হাত ধরে ভোরের পাখির সুরে চলে গেছে অজানা বাগানের দিকে। বিনু’দি এখন ফুলফুল খেলে। আমার কান্না কান্না লাগে। এই সকালে আমারও কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু হয় না…

৭.
বিনু’দির নাম মনে হলে এখন আমার ডানা খসে পড়ে। তার নাম মনে হলে, ভুল হয় নিজের নামের বানান। রাগে, জমানো অভিমানে কুটিকুটি করি কবিতার খাতা। এইসব হাহাকার নিয়ে সন্ধে্যবেলা ছুটি সুবর্ণদহের কাছে। সুবর্ণদহের জলের ঝাপটা এসে ছুঁয়ে ছঁুয়ে দেয় পা। ওপাড়ে আস্ত একটা মেঘ নেমে থাকে। আমি জলের ওপর ভাসিয়ে দিই বুকে জমা খিলখিল সুর। সেই সুর ভেসে ভেসে মেঘ ছুঁয়ে দিলে দহনপাড়ে বৃষ্টি নেমে আসে…এই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে জেনেছি, নদীদেরও দহন আছে। তাদের আসলে আলাদা কোনো নাম নেই। সুবর্ণদহ, ঘাঘট কিংবা শ্যামাসুন্দরী, তারা জানে না তাদের নামের বানান। তারা সবাই ভিন্ন ভিন্ন দহন নিয়ে ছুটে চলা নদী।

৮.
এরপর কেটে গেছে অনেকটা বছর। কেটে গেছে মঙ্গাআঁধার কালো। বড় থেকে বড় হয়ে আছি, সুবর্ণদহ কিংবা শ্যামাসুন্দরী থেকে বহু বহুদূরে। এতটা দূরে এসে জেনেছি, আমারও একজন প্রেমিকা ছিল। অসীম নিঃসঙ্গতা নিয়ে ছিল। নিঃসঙ্গতার ভেতরে থাকতে থাকতে আরও কেউ তাকে ভালোবেসেছিল। সেও বেসেছিল। ভালো বাসতে বাসতে একদিন চোখের আড়ালে সে ফ্রিজশট হয়ে গেল।

৯.
এ পাড়ে বেজে উঠছে জলবালি-সোনারোদ সুর, ওপাড়ে আঁকা ঝুমঝুমপুর, রক্তজবার সারি, ওখানেই শিমলিদের বাড়ি। রোজ বিকেলে সে কাগজে ফুল বুনে বুনে নৌকার ভাষা। শ্যামাসুন্দরীর ঢেউটুকু পেরুলেই ভেসে ওঠে আহলাদপ্রবণ কথা। ঢেউয়ে ঢেউয়ে কথাদের ঘর। তারপর যে কথা উড়ে গেছে বহুদূর ঝুমুর হাওয়ায় ভেসে-তারাও জেনে গেছে, ঢেউয়ের গমকে কথা ভেসে দিয়ে কেউ কেউ ফেরতের ঢেউ গুণে চলে গেছে ঘর, সন্ধ্যার পর।

ও কথা, তুমি ভেসে যাও আজ, তোমার শব্দের কাছে আজ আর বসে নেই কোনা বিষণ্ন খেয়াল…

সোনালু ফুলের স্মৃতি

5 এপ্রিল

সোনালু ফুলের স্মৃতি

পরম মমতা দিয়ে যে ঘর বুনেছি এতকাল, সেই ঘরে তাঁর ফিরে আসার সম্ভাবনায় পথজুড়ে রোজ ছড়িয়ে দিতাম সোনালুর ফুল। ফুলে ফুলে শ্রীমন্ত পথ। এইসব হলুদ দেখেছিল ঘড়ছাড়া প্রজাপতির দল। বহুদিন পর একদিন সোনালু ফুলের কাছে তারা জেনেছিল আমার একান্ত বেদনার কথা। এইসব শুনে বুঝি তাদেরও জেগে ছিল মনে গোপন গহন ব্যথা। তারপর, পাতাবাহারের এক সোহানা বিকেল ফেলে প্রজাপতিরা তাদের ডানায় জমানো সব রঙ দিয়ে গেছে ঢেলে।

রোজ রাতে প্রজাপতির রঙ দিয়ে মেয়েটির ছবি আঁকি, আঁকি সোনালু ফুলের স্মৃতি। আঁকতে আঁকতে প্রজাপতির ডানার ভেতরে রঙের বদলে জমে ওঠে গহন অন্ধকার। আর কোনো এক রাতে এই অন্ধ গহন পথে ঝিঙুরের সুরে সুরে মোহন চোখের মেয়েটি সোনালুর ঘ্রাণ নিয়ে অনায়াসে বেদনার গল্প হয়ে গেছে। তাই পাঠ করি গল্প, পাঠ করি মেয়ে। আর রোজ রাত্রিবেলা কলাবতী নদীটির পাশে আমার ডাকনাম ধরে এক অচিন অন্ধ পাখি সুর করে কাঁদে। যেনো আর কোনো সুর নেই পাখিটির ঠোঁটে। ওই অন্ধ পাখির করুণ সুর ভেসে এলে আজো আত্মার ভেতরে শুধু কেঁপে কেঁপে ওঠে…
___________________________
(পাখিদের রাশিফল থেকে একটি)

আমার প্রথম কবিতার বই `বুকের ভেতর বাবুই-বাসা’

26 ফেব্রু.
বইটির দামঃ ৭৫ টাকা

বইটির দামঃ ৭৫ টাকা

 

[…তারপর এতো-এতকাল কেটে গেল। এতদিনে হারিয়ে ফেলেছি অনেক কিছুই—শৈশবের ঘুড়ি, শিশুমালতির কৌটা, চকচকে মার্বেল আর বিকেল বেলার মাঠসহ বড় বেলার অনেক কিছু। সবই তো হারানোর স্মৃতি। প্রাপ্তিও ছিল, সে প্রাপ্তিও তো একসময় হারিয়ে যায় গাঢ় কোনো অন্ধকারে। যত তুচ্ছ-ই হোক না কেন, তা হারানো মানে আমি জেনেছি হারিয়ে যাওয়াই। প্রাপ্তি শুধু ওইসব হারানোর স্মৃতি আর অকথ্য বেদনা। এই স্মৃতিও মলিন হতে থাকে, মিশে যেতে থাকে অন্য কোনো স্মৃতির জাদুগলিতে। পড়ে থাকে বেদনার রং। হারানোর বেদনাও প্রিয় হতে থাকে প্রেমিকার মতো। তাই বুকের মাঝে বেদনা আগলে রাখি। বেদনার বায়নোকুলারে দেখি হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মুখ, আরও প্রিয় কত কী, যার অনেক কিছুই হয়তো লেখা হয় না কখনো।…..
……শুধু ভালোবাসার কথা, হারানোর কথা, গাঢ় বেদনার কথা আর অন্ধকারে জোনাকির মাঝে কী করে প্রিয়তমার মুখ ভেসে ওঠে সেইসব কথা মমতায় লিখতে গিয়েই খাতাজুড়ে লিখে রেখেছি এইসব, কবিতা। তারপর ধীরে ধীরে বুকের ভেতরে বাসা বেঁধেছে বাবুই। ]
এতো গেলো আমার কথা, এবারে বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে…….

আর কে না জানে, পৃথিবীতে কবিরাই সবচেয়ে সংবেদনশীল। বিশ্বজগতকে ওই সংবেদনে যাচাই করবার এক আশ্চর্য সারল্য তাঁদের আছে। ফলে, সময়ের অন্তর্নিহিত বেদনা ও আনন্দ যুগপত্ উঠে আসে তাঁদের লেখায়। ‘ফাঁকা পোস্টবক্স’ আর ‘শিশুমালতিময় জলেশ্বরী নদী’র বেদনা তবু শুধু কি কবির একার? তা কি একই সঙ্গে আমাদের নয়? তার মর্মের বিরহভার কি আমাদেরও আক্রান্ত করে না? এ বইয়ের কবিতাগুলোতে মৃত নদী আর শৈশবের অনুষঙ্গগুলো বারবার আসে। জলমগ্ন সবুজ শেকড় ছেড়ে আসা একটা প্রজন্মের ইটকাঠের কঠোরতায় ঢুকে পড়ার যাতনা আছে। নাগরিক প্রেমের বিষে এখানে প্রেমিকা নিজেই তার প্রেমিককে হত্যার পর নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। কবিতার ভেতরের গল্পগুলো আমাদের চেনা, আর অচেনা হলেও অন্তত পড়ার পর মনে হয়—এ রকম গল্প আমার, আমাদেরও ছিল।

বইটি বইমেলায় ‘অনিন্দ্য প্রকাশের’ স্টলে পাওয়া যাবে। স্টল নম্বর: ৬০, ৬১, ৬২।
বইটির প্রচ্ছদ করেছেন: Mahhfuz Rahmaan

বিশ্বজিতের রক্তের রং লাল

20 ডিসে.

‘এই নির্জীব সময়ের বুকে তুমি এনে দাও প্রেমের স্পন্দ, চাই একবার শুধু একবার, হোক সব্বার চোখ প্রেমে অন্ধ’ —কাজী কামাল নাসের

 

১.
কারণে অকারণে সুমন ভাই খুব মারতো আমাকে। মারামারি খেলতে গিয়েও মার খেতাম আমি। কোনোভাবেই তাঁকে মারতে না পেরে একা একাই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতাম। স্কুল থেকে ফিরেই বাঁশের শক্ত একটা কঞ্চি নিয়ে উঠে পড়ে লেগে যেতাম যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায়। আমার প্রতিপক্ষ ঘরের পেছনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা নিরীহ কলাগাছ। তখন বেশ মজা পেতাম এই খেলায়। সুমন ভাই দূরে দাঁড়িয়ে দেখত আর মুচকি হাসতো। তখন খুব রাগ উঠে গেলে, ওই কঞ্চি দিয়ে কলাগাছটিকে পাগলের মতো মারতাম। মাঝে মাঝে কলাগাছটিকে খোঁচা দিলে সেটির গা দিয়ে পানি বের হয়ে আসতো। এতেও যখন ঝাল মিটতো না, তখন দৃশ্যের ভেতর কলাগাছটিকে কেটে কুটিকুটি করে দিতাম। কলাগাছটিকে যখন মারতাম মা এসে বলত, ‘বাবা, বৃক্ষরা অবলা। এদেরকে এভাবে মারতে নেই। তোমার মতো গাছেদেরও কষ্ট হয়। ওরাও কষ্টে কাঁদে।’ মা কলাগাছটির গা দেখে বলেছিলেন, ‘এই দ্যাখো তুমি মেরেছ বলেই গাছটির গা দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে, আর মেরো না বাবা।’ মা’র এই কথা শুনে সেদিন খুব কষ্ট হয়েছিল। নিজেকে খুনি, অপরাধী মনে হয়েছিল। অভিমানও জেগেছিল সেদিন; যে সুমন ভাই কী তাহলে জানে না যে, তিনি মারলে আমারও গাছেদের মত কষ্ট হয়। আমার কান্না পায়। এই অভিমান নিয়ে সেদিনই প্রথম জেনেছিলাম, গাছেদের রক্তের রং সাদা। তাদের চোখ নেই তবু তাদের অশ্রুর রং শাদা।

২.
আমাদের বাড়ির পাশে বুড়ির হাট। ওই হাটে প্রতি সোমবার জাদু দেখাতো আসতো অচিন জাদুকর। একেক সপ্তাহে একেকজন করে জাদুকর আসতেন। পরে তাঁকে আর কখনো দেখা যেত না।
প্রতি সোমবার বাবার আঙুল ধরে জাদু দেখতে যেতাম। একদম সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে বাতাসা খেতে খেতে দেখতাম আশ্চর্য সব ম্যাজিক। ফুল ছুঁয়ে দিলেই পাখি আর কাগজ ছুলেই বল। কখনো কাগজে ফুঁ দিলেই টাকা। আমি মুগ্ধ হয়ে এইসব জাদু দেখতাম। আর রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, জাদুকর তো জাদুবলে অনেক টাকা বানাতে পারে। তাহলে জাদু শেষে ওই কিম্ভূত মুখের জাদুকর সবার মতো কেন আমার কাছ থেকেও পকেটে থাকা একমাত্র এক টাকার পুরোনো নোটটা নিয়ে নিল। তবু কেন যেন, গোপনে গোপনে জাদুকর হওয়ার বাসনা পুষে রাখতাম মনে।
একদিন সোমবার হাটে কুচকুচে কালো এক জাদুকর এসে অদ্ভুত সুরে জাদু দেখার আহ্বান জানালেন। আর বললেন, কোনো কথা বলা যাবে না। কথা বললে না কি তাঁর বিপদ হয়ে যাবে। চুপচাপ দেখছে সবাই। জাদুকর একটা চকচকে ধারালো ছুরি দিয়ে নিজেই নিজের হাত কাটছে। আর হাত থেকে মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে লাল লাল জলের নহর। কিছুক্ষণ পরেই সেই লাল লাল জল ভ্যানিশ, আর জাদুকরের হাতও ঠিক হয়ে গেল। সবাই হাততালি দিয়ে মুখরিত করে তুলল জাদুপাড়া। ওই লাল জল দেখে আমার ভেতরে কেমন যেন একটা মিহিন ব্যথা নাড়া দিয়ে উঠেছিল। রাতে বাড়ি ফেরার সময় বাবার আঙুল শক্ত করে ধরে জানতে চেয়েছিলাম, ওই লাল জল আসলে কী? বাবা বলেছিলেন, আসল-নকল জানি না তবে ওগুলো রক্ত। মানুষ খুন হলে রক্ত ঝরে। রক্ত মানে খুন। সেই রাতে জেনেছিলাম, মানুষের শরীরের রক্তের রং গাঢ় লাল। তারপর পুরোটা পথ আমার চোখের ভেতরে ওই রক্তের নহর ভেসে ভেসে যায়। সেই রাতে কী এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে হারিয়ে ফেলেছি আমার জাদুকর হওয়ার রঙিন বাসনা।

৩.
আমাদের বাড়িতে একটা কুকুর ছিল। নাম বাহাদুর। ছিল মানে, গত পরশু বাবা ফোনে জানালেন, বাহাদুর কেন যেন অভিমান করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। গত চার দিন বাহাদুরের কোনো খোঁজ নেই। বাবা দীর্ঘদিন ধরে বাহাদুরকে আদর-যত্ন করতেন। কেউ যদি একটু বাহাদুরকে মারতো তাহলে বাবা খুব খেপে যেতেন। বাহাদুরের আঘাত লাগা স্থানে বাবা হাত দিয়ে ওষুধ লাগিয়ে দিতেন। তাই বাহাদুর নিরুদ্দেশ হওয়ার খবরে বাবা খুব কষ্ট পেয়েছেন। আমারও বেশ খারাপ লেগেছে। বাহাদুরের আচরণ বেশ অদ্ভুত। রাতের বেলায় বাড়িতে চোর এলে, বাহাদুর তাঁকে ঠিক ঠিক আটক করে ফেলতো। কিন্তু কখনো কামড় বসাতো না। তারপর ডেকে ডেকে বাড়ির সবাইকে জেগে তুলে সেই চোরকে সোপর্দ করতো বাহাদুর। কী নিয়ে বাহাদুরের অভিমান, আজ খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

৪.
গত ৯ ডিসেম্বর পুরান ঢাকায় নৃশংসভাবে হত্যা হওয়া বিশ্বজিত্ দাস আমার কেউ ছিলেন না, কখনো দেখিওনি তাঁকে। তবুও তাঁর সেই হত্যা দৃশ্য দেখলে বুকের ভেতরটা কেমন হাহাকার করে ওঠে। জানেন, খুব কষ্ট হয় আমার। যখন ওই দৃশ্য ভেসে ওঠে চোখে, তখন অন্ধ হয়ে যাই আমি। চোখের ভেতরে শুধু লাল আর লাল।
সেইদিন বুঝি বিশ্বজিত্ আমার ছোটবেলার কলাগাছের ভূমিকায় খুব ভালোভাবে উতরে গিয়েছিল। ছেলেবেলার ওই জাদুকরের রক্তের রঙ আর বিশ্বজিতের রক্তের রঙ একই রকম, গাঢ় লাল। বাবা তাহলে সেদিন মিথ্যে বলেননি আমাকে।
বিশ্বজিতের খুনিদের সেদিন কোথায় যেন না পাওয়ার একটা হতাশা ছিল। সেই না পাওয়ার বেদনায় তাঁরা কয়েকজন মিলে একলা বিশ্বজিেক চাপাতির কোপে শেষ করে দিয়ে আশ্চর্য ম্যাজিশিয়ান হয়ে গেল। আর বিশ্বজিতের শরীর থেকে বের হওয়া রক্তের স্রোত দেখে বোঝা গেল, বিশ্বজিত্ মানুষ ছিলেন, তাঁর বাবা ছিল, মা ছিল, সুমন ভাইয়ের মতো ভাই-ও ছিল। তাহলে খুনিদের কে কে আছে?
মা আমাকে শিখিয়েছিল, শুধু মানুষ নয় গাছকে মারলেও তার কষ্ট হয়। বাবা শিখিয়েছিলেন, মানুষ খুন হলে রক্ত বের হয়, লাল লাল। বিশ্বজিত্ও এইসব জানতেন। আর জানতেন বলেই প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু খুনিদের কী শেখানোর কেউ ছিল না?
আমাদের বাড়ির বাহাদুরও তো কোনো চোরকে ধরলে কামড় দিত না। তাহলে ওরা কারা? যারা বিশ্বজিেক প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে খুন করল। বাহাদুরও যে কাজ করে না, ওরা কেন তা করল? ওঁরা তবে কোন মানুষ?

৫.
বিশ্বজিতের প্রেমিকা ছিল কী-না তা জানা হয়নি। থাকলেও হয়তো তিনি গোপনে গোপনে কাঁদছেন কী না সে প্রশ্নও তুলছি না। তবে আমার প্রেমিকা ছিল। ছিল মানে ছিল-ই। রোজ রাতে আমি ঘুমের গোপনে তাঁর ঠোঁটে চুমু দেই। একবার, দুইবার করে মাঝে মাঝে অজস্র চুমু দিয়ে ফেলি প্রেমিকার ঠোঁটে। আমার প্রেমিকা তা কোনোকালে জানবে কী-না জানি না।

৬.
বাবা আমাকে কখনো বলেননি, খুনিদের রক্তের রঙ কেমন? খুনিদের প্রেমিকারা কেমন হয় জানি না। খুনিদের ঠোঁটও কী চকচকে চাপাতির মতো ধারালো? তাঁরাও কী প্রেমিকার ঠোঁটে চুমু দেয়? যদি দেয়, তাহলে তো প্রেমের নামে রোজ রাতে তাঁরা প্রেমিকা হত্যা করে! যদি তা না হয়, তাহলে তাঁদের প্রেমিকাদের ঠোঁট তবে কী দিয়ে বাঁধা।………..

সংগ্রামী বেবির নতুন স্বপ্ন

1 সেপ্টে.

সু জ ন সু পা ন্থ

বেবি খাতুনের মাথার বোঝাটা এবার একটু হালকা হবে। ২০ হাজার টাকা ঋণ আর তার চড়া সুদ বোঝার মতো চেপে ছিল বেবির ওপর। তাই গত ঈদটা যেমনই কাটুক না কেন, সামনের কোরবানির ঈদটা হয়তো দুই ছেলেকে নিয়ে একটু ভালো কাটবে। জীবনের চলার চাকাটা হয়তো একটু মসৃণ হবে।
কারণ, পুরান ঢাকার ভ্যানচালক বেবি খাতুনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন প্রথম আলোর এক পাঠক। প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে ‘দুই ছেলেকে মানুষ করার জন্যই সংগ্রাম’ শিরোনামে বেবি খাতুনের ছবিসহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় গত ২৯ জুন। বেবির ছবিগুলো তুলে এনেছিলেন প্রথম আলোর গ্রাফিকস ডিজাইনার জয়দেব সরকার। ভ্যানচালক বেবি প্রথম আলোর পাঠকদের শুনিয়েছিলেন তাঁর সংগ্রামের কাহিনি।

টাকা তুলে দেওয়া হচ্ছে বেবী খাতুনের হাতে

বেবি খাতুন ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠেছেন অন্যের আশ্রয়ে। অল্প বয়সে বিয়ে। পরপর দুই সন্তান আলম (৮) ও আল আমিন (৩)। সংসারের সুখও তাঁর বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বছর তিনেক হলো স্বামী আলমগীর ছেড়ে যান তাঁদের।
এরপর ঢাকার গেন্ডারিয়ার ঘুণ্টিঘর এলাকার বস্তিতে বসে জীবন চালানোর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না বেবি। বস্তির ঘর ভাড়া মাসে দুই হাজার টাকা, সন্তানদের ভরণপোষণ—এতসব চিন্তায় বিপর্যস্ত বেবি বেছে নেন ভ্যানচালানোর মতো কঠিন জীবন। ভ্যানের প্যাডেলে পা রেখে জীবনকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন তিনি। তাঁর কাজ ইসলামপুর ও পাটুয়াটুলীর বিভিন্ন দোকানদারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের জন্য দুপুরের খাবার সংগ্রহ করা। তারপর সেই খাবার নির্দিষ্ট দোকানে পৌঁছে দেওয়া। এ কাজে সঙ্গে নেন দুই ছেলেকে। বেলা ১১টায় বাড়ি থেকে বের হয়ে বেলা দুইটা পর্যন্ত চলে এ কাজ। দোকানিদের খাওয়া শেষ হলে আবারও খাবারের পাত্রগুলো সংগ্রহ করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। এরপর ছুটি।
খাবারের বাটিগুলোতে যতটুকু খাবার অবশিষ্ট থাকে, তা একত্র করে দুই ছেলেকে খাওয়ান এই মা। এ কাজ করে তাঁর মাসে আয় হয় সাত হাজার টাকা। তা দিয়ে কোনোমতো চলে তিনজনের সংসার।
বেবির জীবন-সংগ্রামের গল্প প্রকাশ হওয়ার পর নিউইয়র্ক থেকে যোগাযোগ করেন প্রথম আলোর একজন পাঠক। তিনি আর্থিক সাহায্য করতে চান বেবি খাতুনকে। তিনি জানান, ছোট দুটি মেয়ে বেবির কাহিনি শুনে তাঁদের জন্য স্কুল থেকে ৩০০ মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে। এই অর্থের সঙ্গে তিনি আরও ৭০০ মার্কিন ডলার যোগ করে মোট এক হাজার ডলার ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন জয়দেব সরকারের কাছে। আজ শুক্রবার সকালে বেবির হাতে তুলে দেওয়া হয় এই টাকা।
তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন, সেই সূত্রে সাহায্য—এসবের অনেক কিছুই ঘটে গেছে বেবির অজ্ঞাতে। তাই একসঙ্গে এত টাকা হাতে পাওয়াটা ছিল তাঁর কাছে অনেকটা স্বপ্নের মতো। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাই মনের রাশ আলগা করে তাঁর ঝুপড়ি ঘরের মেঝেতে বসে বলতে থাকেন এই টাকা দিয়ে কী করবেন।
ঋণ এখন সুদে-আসলে দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার টাকা। এখান থেকে আগে শোধ দিয়ে দেবেন সেটা। তারপর যা থাকে সেখান থেকে কিছু টাকা বিশ্বস্ত কারও কাছে জমা রাখবেন দুই ছেলের পড়ার জন্য। নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি, এই দুঃখ তাঁর যায় না। বেবি জানান, এবার ঈদে তেমন কিছু কিনতে পারেননি। তাই আসছে ঈদে দুই ছেলেকে কিছু কিনে দেবেন। দুই ছেলে নিয়ে একাই চলবেন তিনি।

ছবি ও ভিডিও: মনিরুল আলম

 

[ লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো’র অনলাইন সংস্করণে ৩১ আগস্ট ২০১২ তারিখে আমার কেতাবি নামে প্রকাশিত ]

আফরিনের বাঁচার স্বপ্ন

11 জুলাই

সু জ ন সু পা ন্থ

রাজধানীর মহাখালীতে আয়েশা মেমোরিয়াল বিশেষায়িত হাসপাতালের বারান্দায় বসে তসবি গুনছেন মা হেলেনা আক্তার। মাঝে মাঝে শাড়ির আঁঁচলটা তুলে চোখটা মুছে নিচ্ছেন তিনি। পাশে অস্থির পায়চারি করে যাচ্ছেন আফরীনের মামা আল-আমিন। গ্লাস ঘেরা দরজার ফাঁক দিয়ে একেকবার উঁকি মেরে দেখছেন কী করছে আফরীন। আর নিবিঢ় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) ভেতরে নাকে মুখে খাবার ও অক্সিজেনের নল নিয়ে শুয়ে আছে আফরীন।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌরসভার শান্তিবাগ এলাকার মেয়ে আফরিন। সেপটিসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে যকৃত্, ফুসফুস ও কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে গেছে তাঁর। ২০০৯ সালে এসএসসি ও ২০১১ সালে এইচএসসি (বিজ্ঞান বিভাগ) পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাসসহ জিপিএ-৫ অর্জন করেন আফরিন। চলতি বছর মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু এরই মাঝে গত ১৬ জুন তাঁর শরীরে বাসা বাধা ব্যাধিটি শনাক্ত করেন চিকিত্সক। পটুয়াখালী ও বরিশাল হাসপাতাল ঘুরে গত ২৩ জুন তাঁকে ভর্তি করানো হয় আয়েশা মেমোরিয়াল বিশেষায়িত হাসপাতালে। এখনও সেখানেই আছেন তিনি।

হাসপাতালের আইসিইউতে শুয়ে থাকা আফরীনের চোখ দুটো বন্ধই থাকে বেশির ভাগ সময়। মাঝে মাঝে কোনো শব্দ পেলে এদিক-ওদিক একটু তাকান। কিছুদিন আগেও কোনো বোধ শক্তি ছিল না তাঁর। চোখও খুলতেন না তেমন। এখন পরিচিত কেউ সামনে গেলে তাঁকে চিনতে পারেন, ইশারা করেন। হয়তো এখন বুঝতে পারেন অনেক কিছুই। অজানা ভবিষ্যতের শঙ্কায় চোখ খুলেই অঝোরে কাঁদতে থাকেন। সেই কান্না কাঁদিয়ে যায় মা-মামাসহ হাসপাতালের চিকিত্সকদেরও।

আফরীনের চিকিত্সার জন্য শুরুতে দরকার ছিল ১৫ লাখ টাকা। বাবা বাবুল তালুকদার ভালোবাসার একমাত্র মেয়েকে বাঁচাতে এই টাকা জোগাড় করার জন্য হাত পেতেছেন মানুষের কাছে। প্রথম আলোর অগণিত পাঠকসহ অনেকেই আবার আফরীনকে বাঁচাতে বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। বর্তমানে আফরীনের জন্য জমা পড়েছে পাঁচ লাখ টাকা। এছাড়া আরও একটি অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে প্রায় ৭০ হাজার টাকা। আফরীনকে বাঁচাতে মানুষের এই সাড়া পেয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন আফরীনের স্বজনেরা। এদিকে চিকিত্সকও জানিয়ে দিয়েছেন, আফরীন মোটামুটি একটি জটিল সময় পেরিয়ে এসেছে। তাই খুব বেশি নয়, আর মাত্র পাঁচ লাখ টাকা হলেই হয়তো বাঁচানো যাবে মেধাবী আফরীনকে।

‘আফরীনকে বাঁচানোর জন্য যা করা দরকার আমরা তাই করব। তারপরও চাই আমাদের মেয়েটা বেঁচে উঠুক। আবারও হাসুক। একবার তাঁর মুখে হাসি দেখতে চাই।’—কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন আফরীনের মামা আল-আমিন। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদেরতো অতো টাকা পয়সা ছিল না। তাই ঢাকায় এসে যখন শুনলাম ১৫ লাখ টাকা লাগবে, তখন সব আশা ছেড়ে দিয়ে আমরা আফরীনকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই হাসপাতালের ডাক্তারেরা খুব ভালো। তাঁরাই প্রথম বলেছিলেন, আফরীনকে অন্তত ৭২ ঘণ্টার জন্য হাসপাতালে রেখে দিন। একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখি। তারপর না হয় তাঁকে নিয়ে যাবেন। ডাক্তারের কথায় আফরীনকে এখানে রেখে দেই। সেই থেকে তাঁর চিকিত্সা চলছে। এখানে চিকিত্সকদের কোনো অবহেলা নেই। আফরীন যদি বেঁচে যায় তাহলে এখানকার ডাক্তারের চেষ্টা আর মানুষের সহযোগিতায় সে বেঁচে উঠবে।’

আয়েশা মেমোরিয়াল বিশেষায়িত হাসপাতালে আফরীনের  চিকিত্সক কাজী রফিকুল আলম জানান, ‘শুরুতে যখন আফরীন এখানে আসে তখন তাঁর অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। বর্তমানে আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে সে। তবে আফরীন অনেক ভয় পায়। এ কারণেই তাঁকে আইসিইউ থেকে বের করা যাচ্ছে না। আমরা চেয়েছি আফরীনকে আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে। যদিও টাকাটা এখানে মূখ্য, তারপরও আমরা ভেবেছি যেমন করে হোক আগে তাঁকে সুস্থ করা চাই। এমন একটা মেধাবী মেয়ে শুধু টাকার কাছে হেরে যেতে পারে না। তাই এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছি। জনগণের সহযোগিতা আর আল্লাহর করুণায় হয়তো সেরে উঠবে আফরীন।’

আফরীনের আরেক চিকিত্সক আবদুল ওয়াদুদ বেগ বলেন, শুরুতে আফরীন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ছিল। পরে সেটা সংক্রমিত হয়ে আজকের এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। প্রথম দিকে তার রোগটা ভয়ানক হলেও আফরীন এখন কিছুটা উন্নতির পথে। চার-পাঁচবার তাঁর কিডনি ডায়ালাইসিস করানো হয়েছে। আফরীনকে নিয়ে এখনও শঙ্কা কিন্তু রয়েই গেছে। তবে সম্ভাবনাটাও কম নয়।’

আফরীনের খবর প্রকাশের পর দেশ-বিদেশ থেকে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। প্রতিদিনই কেউ না কেউ সরাসরি হাসপাতালে গিয়ে আফরীনের চিকিত্সার জন্য টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। কেউবা নিচ্ছেন তাঁর খোঁজ-খবর। এভাবেই আফরীনের জন্য হাসপাতালেই জমা পড়েছে পাঁচ লাখ টাকা। আর ‘মো. শাহ আলম, হিসাব নম্বর-টি-১৪২৮, সোনালী ব্যাংক, কলাপাড়া বন্দর শাখা, পটুয়াখালী’ এই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে ৭০ হাজার টাকা। এখন আর মাত্র পাঁচ লাখ টাকা হলেই আফরীনের জন্য টাকার চিন্তাটা কমে যাবে তাঁর বাবা-মার। আর এতেই হয়তো বেঁচে যেতে পারে আমাদের সবার আফরীন।

আফরীনকে টাকা পাঠানোর ঠিকানা—মো. শাহ আলম, হিসাব নম্বর-টি-১৪২৮, সোনালী ব্যাংক, কলাপাড়া বন্দর শাখা, পটুয়াখালী। খন্দকার সাইফুল, হিসাব নম্বর-৪০০৫১২১০০০৫৪৮১৫, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, বৈদেশিক বাণিজ্য শাখা, ঢাকা এই ঠিকানাতেও পাঠাতে পারেন সাহায্য। এছাড়া ০১৭১৬৫৫৪৬৫০ এই নম্বরে আফরীনের মামা আল-আমিনের সঙ্গে এবং ০১৭২১৫৩৯৯২৬ এই নম্বরে আফরীনের বাবা বাবুল তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগও করা যাবে।

‘আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি-আপনারা আমার মেয়েটারে বাঁচান। এতো টাকা আমি কই পামু। আপনারাই একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে আফরীনকে বাঁচাতে পারেন।’ আফরীনের মা হেলেনা আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন এসব কথা। তারপর আর কোনো কথা বলতে পারেননি তিনি।

[ লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো’র অনলাইন সংস্করণে গত ১০ জুন ২০১২ তারিখে আমার কেতাবি নামে প্রকাশিত ]

গাড়িতেই বাড়ি !

1 জুলাই

সু জ ন সু পা ন্থ

একটু আরাম-আয়েশে বসবাস করার জন্য বাড়ি-গাড়ির কথা ভাবেন না এমন মানুষের খোঁজ মেলা ভার। তবে, যারাই এই ভাবনা ভাবেন না কেন-আগে মাথা গোঁজার ঠাঁই বাড়ি তারপর ভাবেন গাড়ির কথা। কিন্তু এবারে একটু ভিন্ন ভাবনার মানুষের গল্প শুনি। যারা কিনা বাড়ির আগে গাড়ি কিনে ফেলেছেন। তাহলে তাঁরা থাকেন কোথায়? এ প্রশ্ন আসতেই পারে। একটাই উত্তর, ওই গাড়িই তাঁদের বাড়ি।

একটু আলাদাভাবে ভেবেই বাড়ির আগে গাড়ি কিনে ফেলেছেন যুক্তরাজ্যের ক্যান্টারবেরি শহরের ড্যানিয়েল বন্ড ও স্ট্যাসি দম্পতি। ২৮ বছর বয়সী ড্যানিয়েল বন্ড পেশায় গাড়ি মেরামতকারী। এই কাজ করে তিনি যে পরিমাণ অর্থ জমিয়েছেন তা একটি বাড়ি কেনার জন্য মোটেও যথেষ্ট ছিল না। কিন্তু স্ত্রী স্ট্যাসিকে (২০) নিয়ে একটু নিরাপদে থাকতেও হবে তাঁকে। এ নিয়ে বেশ ভাবনায় পড়ে যান তিনি। বাড়ি কেনার জন্য ব্যাংকও রাজি হয়নি ঋণ দিতে। আর অন্যের বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে নারাজ দুজনেই। তাই বাধ্য হয়ে দুজনে মিলে শলা-পরামর্শ করে একটি বড়সড় গাড়ি কেনার কথা ভাবেন। তাঁদের ভাবনার কথা শুনে ড্যানিয়েলের মা তাঁকে ‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে’ বলে ড্যানিয়েলকে রাগারাগিও করেছিলেন। সেই চোখ রাঙানিকে থোড়াই কেয়ার করে নিজেদের সিদ্ধান্তেই অটল থেকেছিলেন তাঁরা। তাঁদের চাওয়া এমন একটি গাড়ি, যাতে সারা শহর মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ানো যাবে, সেই সঙ্গে খাওয়া-দাওয়াসহ গাড়ির ভেতরে একটু নিরাপদে ঘুমানোও যাবে। যেই ভাবনা সেই কাজ। অর্থকড়ি গোছগাছ করে তিন হাজার পাউন্ড দিয়ে গত বছরের অক্টোবরে লেল্যান্ড অলিম্পিয়া-১৯৯১ মডেলের একটি দ্বিতল বাস কিনে ফেলেন তাঁরা। এরপর আট হাজার পাউন্ড বাড়তি খরচ করে সেই বাসের ভেতরে দুইটি থাকার কক্ষসহ বাড়ির মতো করে বানিয়ে নিয়েছেন ড্যানিয়েল ও স্ট্যাসি দম্পতি। এখন তাঁরা সেই বাড়ি মানে গাড়িতেই থাকেন, ঘর-সংসার করেন।

বাসটির ভেতরে এখন তাঁদের থাকার জন্য দুইটি কক্ষ, একটি রান্নাঘর, টেলিভিশন কক্ষ, প্রসাধন কক্ষ, পানির ট্যাঙ্ক এমনকি একটি বারও আছে।

‘শুরুতে আমরা বাড়ি নিয়ে বেশ হতাশায় পড়েছিলাম। ক্যান্টারবেরিতে ছোট্ট একটি ফ্ল্যাট কিনতে প্রায় এক লাখ পাউন্ড দরকার। অতো অর্থ আমাদের ছিল না। কিন্তু টাকা খরচ করে অন্যের বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকারও ইচ্ছে ছিল না আমাদের। তাই অল্প অর্থ খরচ করে গাড়ি কিনে তার ভেতরে বাড়ি বানিয়ে থাকার কথা চিন্তা করি। প্রথমে বেশ জটিল মনে হলেও পড়ে বুঝতে পারি এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে সহজ সমাধান।’—বলছিলেন ড্যানিয়েল বন্ড।

ড্যানিয়েল-স্ট্যাসির গাড়ির ভেতর বানানো এই বাড়িতে প্রায় ২২০ লিটার পানি ধারণ করার মতো ট্যাঙ্ক রয়েছে। তাছাড়া সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের ব্যবস্থাও আছে গাড়িতে। রান্না ঘরের ভেতরে আছে চুলা, রেফ্রিজারেটর ও কিচেন ক্যাবিনেট।

স্ট্যাসি বলেন, ‘এটা আমার খুব ভালো লেগেছে। খুবই ভালো একটি উদ্যোগ। আমাদের একটি বাড়ির খুব প্রয়োজন ছিল। ড্যানিয়েল অনেক কষ্ট করেছে এজন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্থ জোগাড় করতে পারেননি। তাতে কী! এখন তো এটাই আমাদের দু’জনের নিজেদের বাড়ি।’

ড্যানিয়েল আরও বলেন, বাসটির ভেতরে ঢুকলে কেউ বলতে পারবে না যে, এটা একটা বাস। এটা আসলে পুরোদমে একটি নতুন বাড়ি।’

বাসটি বর্তমানে একটি খোলা জায়গায় রাখা আছে। তবে ড্যানিয়েল আশা করছেন, সামনের আগস্টেই তিনি গাড়িটির চালক হিসেবে লাইসেন্স পেয়ে যাবেন। আর তা হাতে পেলেই ওই বাড়িতুল্য গাড়িতে স্ট্যাসিকে নিয়ে ঘুরে আসবেন কর্নওয়েল থেকে। যেখানে কেটেছে তাঁর শৈশব, তাঁর কৈশোর। ওয়েবসাইট।

© [লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো’র অনলাইন সংস্করণে গত ৩০ জুন  ২০১২ তারিখে প্রকাশিত]

যে ছবি কথা বলে

2 জুন

রাজীব-সোনিয়া যখন আইসক্রিম খাচ্ছিলেন

দিল্লির ইন্ডিয়া গেটের সামনে আইসক্রীম হাতে রাজীব গান্ধী ও সোনিয়া গান্ধী

 

বাইরে বেশ গরম। এই গরমে ফাঁকা রাস্তার মোড়ে একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে আইসক্রিমওয়ালার কাছ থেকে আইসক্রিম নিয়ে তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন। সঙ্গে তাঁর সদ্য বিবাহিত স্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছেন, অথচ তাঁদের সঙ্গে কোনো নিরাপত্তারক্ষী নেই! এমনটা কি ভাবা যায় আজকের দিনে! মোটেও না। কিন্তু সত্তরের দশকের শুরুর দিকের একটি ছবিতে এমনই দেখা গেছে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ও তাঁর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধীকে। দিল্লির ইন্ডিয়া গেটের সামনে বেশ হাস্যোজ্জ্বলভাবেই তাঁরা ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। আর ইতিহাস হয়ে যাওয়া এ ছবিটি সে সময় ক্যামেরাবন্দী করার সুবর্ণ সুযোগটি পেয়েছিলেন আলোকচিত্রী বলদেব কাপুর। এমনই একটি ছবি ও তাঁর পেছনের কথা নিয়ে আজ শুক্রবার এনডিটিভি অনলাইনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

 

শুধু রাজীব-সোনিয়ার এমন একটি ঐতিহাসিক ছবি ক্যামেরাবন্দী করেই তৃপ্ত হননি বলদেব। বরং ভারতের তুমুল জনপ্রিয় এই গান্ধী পরিবারের একগাদা ছবি তুলে তিনি নিজেও ইতিহাস হয়ে আছেন আজ। শুধু তা-ই নয়, গত পাঁচ দশক ধরে নিজের ক্যামেরায় ভারতের ইতিহাস ক্যামেরাবন্দী করার মাধ্যমে তিনি বিখ্যাত আলোকচিত্রী হিসেবে নিজের নামটিও ইতিহাসে লিখে নিয়েছেন সন্দেহ নেই। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে দালাইলামা এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভারত সফরের মুহূর্তগুলোও ক্যামেরাবন্দী হয়ে আছে বলদেব কাপুরের ক্যামেরায়।

বলদেবের তোলা এসব ছবির এখন অনেকগুলোই বিভিন্ন ফটো এজেন্সিতে রাখা আছে। অনেকেই সেসব ছবি দেখে স্মৃতিও তাড়িয়ে বেড়ান। এসব ছবি এখনো কারও কারও চোখে সেই ইতিহাসকে জীবন্ত করে তোলে।

রাজীব গান্ধী ও সোনিয়া গান্ধীর সেই বিখ্যাত আইসক্রিম খাওয়ার ছবি প্রসঙ্গে বলদেব কাপুর বলেন, ‘এ ছবিটি তোলার পেছনে একটি লম্বা গল্প আছে। আর এটার সবটাই সম্ভব হয়েছে রাজীবের মা ইন্দিরা গান্ধীর সৌজন্যে। আমি জানি না, কীভাবে তিনি আমাকে খুঁজে বের করেন। তখন রাজীব ও তাঁর ভাই সঞ্জয় ছোট ছিলেন। তাঁদের মা একদিন তাঁদের ছোটবেলার ছবি তোলার জন্য আমাকে বললেন। তারপর থেকে শুরু। ইন্দিরা গান্ধী অবশ্য সেসব ছবি থেকে বাছাই করে একটি করে ছবি তাঁর ওয়ালেটে রেখে দিতেন। এর ঠিক ছয় মাস পর যখন রাজীব ও সঞ্জয় আরেকটু বড় হয়ে উঠেছেন ঠিক তখনই আবারও প্রধানমন্ত্রী বাসভবনে ছবি তোলার জন্য ডাক পড়ল আমার। আমি আবারও ইন্দিরা গান্ধীর ওয়ালেটে রেখে দেওয়ার মতো করে দুই ভাইয়ের ছবি তুলে দিলাম।’

এরপর রাজীব গান্ধী বড় হয়ে যখন রাজনীতিতে যোগ দিলেন তখন ভারত সরকার ও কংগ্রেস পার্টির কাছে তাঁর ছোটবেলার ছবিগুলোর ব্যাপক চাহিদা বেড়ে যায়। এ ছাড়া রাজীব গান্ধী যখন কোনো জায়গা সফর করতেন তখন তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই থাকতেন আলোকচিত্রী বলদেব কাপুর।

বলদেব জানান, ‘রাজীব গান্ধী খুবই সহানুভূতিশীল মানুষ ছিলেন। তিনি আমাকে বাইরে দেখলেই জিজ্ঞেস করতেন, আপনি খেয়েছেন? এখানে থাকার মতো জায়গা আছে তো আপনার?’

‘দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলের ইতালির একজন মেয়েকে বিয়ে করার বিষয়ে মানুষ আগ্রহী হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে গণমাধ্যমের আগ্রহও ছিল বেশ। এ সময় বেশ কিছু আলোকচিত্রী তাঁর বিয়ের ছবি তোলার জন্য পাপারাজ্জির মতো লেগে থাকত। কিন্তু এ রকম চুরি করে ছবি তোলা আমি পছন্দ করতাম না।’

একটি অনুষ্ঠানে স্রেফ চুরি করে সোনিয়া ও রাজীবের ছবি তোলার কারণে এক আলোকচিত্রীর ক্যামেরা কেড়ে নিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। এর কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছিলেন, কেন তাঁকে না জানিয়ে ছবি তোলা হলো। এ কারণেই ক্যামেরা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এ ঘটনা শোনার পর সেই অনুষ্ঠানেই বলদেব রাজীব গান্ধীর কাছে তাঁদের ছবি তোলার জন্য অনুমতি চান। তখন রাজি হয়ে যান রাজীব। ভাগ্যের ফেরে আরও কিছু ইতিহাস সেদিন ক্যামেরাবন্দী করার সুযোগ লুফে নেন বলদেব কাপুর।

এরপর একদিন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে সকাল থেকে রাজীব ও সোনিয়ার ছবি তোলা শুরু করেন বলদেব। ঘুরে ঘুরে দিল্লির চাঁদনী চক ও লালকেল্লায় তোলা হয় ছবি। বলদেব নিজেই চালাচ্ছিলেন গাড়ি। পেছনে বসা রাজীব-সোনিয়া দম্পতি। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তাঁর বউয়ের জন্য সঙ্গে কোনো নিরাপত্তারক্ষী ছিল না সেদিন। গরমও পড়েছিল খুব। গাড়ি যখন ইন্ডিয়া গেট পেরিয়ে যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে এক আইসক্রিমওয়ালাকে দেখে রাজীব গান্ধীকে আইসক্রিম খাওয়ার জন্য আহ্বান জানান বলদেব। সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যান রাজীব। এরপর রাজীব ও সোনিয়া গাড়ি থেকে নেমে আইসক্রিমওয়ালার একদম কাছে গিয়ে আইসক্রিম নিয়ে খেতে শুরু করেন। এমন সময় বেশ কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দী করে নেন বলদেব কাপুর।

এসব বিষয় সোনিয়া গান্ধী পছন্দ করতেন কি না জানতে চাইলে মৃদু হেসে বলদেব জানান, ‘সব সময় তিনি খুব লাজুক ছিলেন।’

এনডিটিভি থেকে অনূদিত

[লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো’র অনলাইন সংস্করণে গত ১ জুন  ২০১২ তারিখে প্রকাশিত]

রে ভগবান

29 এপ্রিল

রে ভগবান

ও ভগবান,
তোর মনে কী শুধুই কষ্ট জমা বেশি
অজস্র সেই সব কষ্ট-ব্যাথার ভিড়ে
তোর হূদয়টা যাচ্ছে বুঝি ছিঁড়ে
নইলে কেন কষ্ট পাঠাস দিবানিশি।

কষ্ট দিয়ে তুই আহলাদে আটখানা
চুপটি মেরে তাই দেখিস ব্যাকুলতা
দেখ, সবকিছুতেই আমার নীরবতা
কষ্ট দিবি দে, তোকে করবো না তো মানা।

হে ভগবান,
বলতো এই সব বলছি কেন আজ
কেন তুই যত্ন করে কষ্ট দিলি বেশ
আমার সঙ্গে তোর কিসের এতো রেশ
তোর তো দেখি একফোঁটাও নেই লাজ।

বৃথাই কেন পাঠাস এসব রোজ
তুই কী ভাবিস এসব আমার ভুল
দেখ, আমি কিন্তু কষ্টতেই মশগুল
তাই, তুই বরং অন্য কাউকে খোঁজ।

রে ভগবান,
ভাবলি কী রে, কষ্ট কোথায় তুলে রাখি
তোর কী আছে, পারলে এইবার দেখা
শোন, আমি কিন্তু তোর মত নই একা
সঙ্গে রাখি কষ্ট তাড়া মন্ত্র জানা পাখি।

…………………….
সুজন সুপান্থ
মোহাম্মদপুর, ঢাকা
৮ এপ্রিল ২০১২

হিটলারের অজানা কথা

18 এপ্রিল

হিটলার ল্যান্ড বইটির প্রচ্ছদ

‘জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর ফুয়েরার অ্যাডলফ হিটলারকে কখনো সামনে থেকে না দেখলেও আকস্মিকভাবে এত দিন পর এবার তাঁর খুব কাছে পৌঁছে যেতে পেরেছি, সামনে থেকে দেখেছি, স্পর্শ করেছি এমনকি তাঁর শরীরের গন্ধ পর্যন্তও আমি নিতে পেরেছি।’ দৃশ্যত না ঘটলেও এত ঘটনা যে ঘটল, তার সবটাই কিন্তু সম্ভব হয়েছে অ্যানড্রিউ নাগোরস্কির লেখা হিটলার ল্যান্ড বইটি পড়ে। বইটির ভেতর এত চমত্কার বুননে নাগোরস্কি হিটলারের বর্ণনা করেছেন, তা যেন চোখের সামনে ছবি হয়ে ভাসে। যেন মনে হলো দৃশ্যগুলো এই মাত্র আমার চোখের সামনেই ঘটে গেল। আর আমি তাঁর সাক্ষাত্ দর্শক-শ্রোতা।’ অ্যানড্রিউ নাগোরস্কির (নিউজউইকের সাবেক প্রতিনিধি) লেখা ‘হিটলার ল্যান্ড’ বইটির আলোচনায় এমনভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন আলোচক ক্রিস্টোফার ডিকি।

বইটিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময় থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকের অভিজ্ঞতাই তুলে ধরেছেন লেখক। আর এই লেখাই হিটলারকে একই সঙ্গে মানবিক, নিষ্ঠুর, প্রতিনিধি, কূটনৈতিক, ব্যবসায়ী, তোষামোদকারী ও সবশেষে একজন সৈনিক হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আমাদের কাছে।

আমেরিকার অনেকেই বিশেষ ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে। আর আমেরিকার এই সাংবাদিক বার্লিনে হিটলারের খুব কাছাকাছি যাওয়ার পুরো সুবিধাটাই যেন ভোগ করে নিয়েছেন।

সিবিএস রেডিওর কর্মকর্তা ইয়াং উইলিয়াম শিরের তাঁর ডায়েরিতে হিটলারকে নিয়ে নানা বিষয় লিখেছেন। ১৯৩৮ সালে মিউনিখ কনফারেন্সের আগের দিন হিটলার যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা-ও দেখেছিলেন তিনি। কোনো ধরনের সহিংসতা ছাড়াই চেকস্লোভাকিয়া থেকে জার্মানিকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সমর্থন করেছিল বলে ওই বক্তব্যে দাবি করেছিলেন হিটলার।

ইয়াং উইলিয়াম শিরের তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, বক্তব্য দেওয়ার সময় হিটলারকে বেশ বিচলিত মনে হচ্ছিল। আর এসবই খুব কাছ থেকে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখেছিলেন তিনি। বক্তব্য দেওয়ার পুরো সময়টাই হিটলার বারবার তাঁর কাঁধ ঝাঁকাচ্ছিলেন।

‘সামনের দিকে থাকা দর্শক-শ্রোতারা কিন্তু এসবের কিছুই দেখতে পায়নি। কিন্তু আমি তা দেখতে পেয়েছিলাম ঠিকই। প্রথমবারের মতো আমি তাঁকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে বুঝতে পারি, আজ হিটলার তাঁর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছেন।’ ডায়েরিতে এভাবেই লিখেছেন উইলিয়াম শিরের।

চা চক্রে হিটলার

হিটলারের জয়ের ঠিক কিছুদিন পরই শিরের দেখলেন, একটা হামবড়া ভাব চলে এসেছে তাঁর আচরণে। খিঁচুনি ভাবটা চলে গেছে।

হিটলারের সঙ্গে অপ্রত্যাশিতভাবে সবচেয়ে বেশি যাঁদের সামনা-সামনি দেখা হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন আমেরিকার নারী। ১৯২০ সালের শুরুর দিকে নিউইয়র্কে হেলেন নেইমার নামের এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। হেলেন নেইমার ছিলেন আর্নেস্ট পুতজি নামের জার্মান-আমেরিকান এক কূটনীতিকের স্ত্রী। তিনি পুতজি নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। পরে অবশ্য পুতজি হিটলারের ব্যক্তিগত উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন।

হেলেন নেইমার পরে বলেছিলেন, তাঁর নািস নেতা নপুংসক ছিলেন। কিন্তু হিটলার তাঁর সঙ্গে অনেক বেশি সময় কাটাতে চাইতেন। ১৯২৩ সালের দিকে ব্যাভেরিয়ার সরকারের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা যখন তাঁর ব্যর্থ হলো, তখন হিটলার পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। পরে অবশ্য হেলেন নেইমারের ঘরে দুজন একসঙ্গে ধরা পড়েছিলেন।

এরপর নিজেই নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হিটলার বলেছিলেন, ‘এখন সব কিছুই হারিয়েছি—বাকি আর কিছু নেই!’ এ সময় পিস্তলসহ হিটলারের হাত ধরে ফেলেছিলেন হেলেন। সে সময় জার্মানদের মধ্যে যাঁরা হিটলারের আদর্শকে বিশ্বাস করেন, তাঁদের কথা মনে করিয়ে দিয়ে হেলেন বলেছিলেন, ‘আপনি যা করছেন, তা কি ভেবে দেখেছেন? আপনার সামনে এগিয়ে যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে তাঁরা।’ এভাবেই হিটলারের কাহিনিগুলো লিপিবদ্ধ হয়েছে অ্যানড্রিউ নাগোরস্কির ‘হিটলারল্যান্ড’ বইটিতে।

এরপর কারাগার থেকেই হিটলার লিখেছিলেন বিখ্যাত বই ‘মেইন ক্যাম্প’। গ্রেপ্তার হওয়ার প্রায় এক দশক পর সত্যিকার অর্থে ক্ষমতা পেয়েছিলেন হিটলার।

সময়গুলো বদলে গিয়েছিল কিন্তু তার পরও হিটলারের পাশেই ছিলেন সেই হেলেনের স্বামী পুতজি। হিটলারের একনায়কত্বের প্রথম বছর পর্যন্ত সব দৃশ্যেই তিনি ছিলেন। এ সময় পুতজি হিটলারের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সুন্দরী মেয়ে মার্থা ডডের পরিচয় করিয়ে দেন। হিটলারের ওই মুহূর্তে একজন নারীর প্রয়োজন। আর হিটলারের এই প্রয়োজনের কথাটি পুতজি সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন মার্থাকে। এরপর অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে বার্লিনের একটি হোটেলে হিটলারের সামনে মার্থাকে উপহার হিসেবে নিয়ে আসেন পুতজি। কিন্তু এই ঘটনা আগে থেকে ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি হিটলার। একান্তে সামনে পেয়েই মার্থার হাতে চুমু দিলেন হিটলার। মিনমিন করে কী যেন বলে আবারও তাঁর হাতে চুমু দিলেন তিনি। এরপর সেই দিন পুরো সময়টা মার্থার সঙ্গে অতি উত্সাহ আর অস্বস্তি নিয়ে কাটিয়েছিলেন হিটলার।

এমনই সব কাহিনি রূপায়িত হয়েছে পুরো বইটিতে। অসম্ভব সুন্দর উপস্থাপনায় যেন পুরো বিষয়টিই একটা চিত্রকল্প। বইটির শেষে এসে আরও বিস্মিত হতে হয় পাঠকদের। প্রশ্ন উঠতে পারে, হিটলার যদি সে সময় আত্মহত্যা করতেন, তাহলে কী হতো? আমেরিকার এই প্রত্যক্ষদর্শী লেখক কী গোটা দুনিয়ায় হিটলারের এই পাগলামো লুকাতে পারবেন? যদি তা না পারেন, তাহলে কী হবে? কিন্তু প্রকৃত অর্থে তাঁরা যা দেখেছেন, এই ইতিহাসে তার পুরো একটা নির্যাসই যেন ফুটে উঠেছে দারুণভাবে।

নিউজ উইক থেকে অনূদিত

[লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো’র অনলাইন সংস্করণে গত ১৭ এপ্রিল ২০১২ তারিখে আমার কেতাবি নামে প্রকাশিত]