আফরিনের বাঁচার স্বপ্ন

11 জুলাই

সু জ ন সু পা ন্থ

রাজধানীর মহাখালীতে আয়েশা মেমোরিয়াল বিশেষায়িত হাসপাতালের বারান্দায় বসে তসবি গুনছেন মা হেলেনা আক্তার। মাঝে মাঝে শাড়ির আঁঁচলটা তুলে চোখটা মুছে নিচ্ছেন তিনি। পাশে অস্থির পায়চারি করে যাচ্ছেন আফরীনের মামা আল-আমিন। গ্লাস ঘেরা দরজার ফাঁক দিয়ে একেকবার উঁকি মেরে দেখছেন কী করছে আফরীন। আর নিবিঢ় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) ভেতরে নাকে মুখে খাবার ও অক্সিজেনের নল নিয়ে শুয়ে আছে আফরীন।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌরসভার শান্তিবাগ এলাকার মেয়ে আফরিন। সেপটিসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে যকৃত্, ফুসফুস ও কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে গেছে তাঁর। ২০০৯ সালে এসএসসি ও ২০১১ সালে এইচএসসি (বিজ্ঞান বিভাগ) পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাসসহ জিপিএ-৫ অর্জন করেন আফরিন। চলতি বছর মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু এরই মাঝে গত ১৬ জুন তাঁর শরীরে বাসা বাধা ব্যাধিটি শনাক্ত করেন চিকিত্সক। পটুয়াখালী ও বরিশাল হাসপাতাল ঘুরে গত ২৩ জুন তাঁকে ভর্তি করানো হয় আয়েশা মেমোরিয়াল বিশেষায়িত হাসপাতালে। এখনও সেখানেই আছেন তিনি।

হাসপাতালের আইসিইউতে শুয়ে থাকা আফরীনের চোখ দুটো বন্ধই থাকে বেশির ভাগ সময়। মাঝে মাঝে কোনো শব্দ পেলে এদিক-ওদিক একটু তাকান। কিছুদিন আগেও কোনো বোধ শক্তি ছিল না তাঁর। চোখও খুলতেন না তেমন। এখন পরিচিত কেউ সামনে গেলে তাঁকে চিনতে পারেন, ইশারা করেন। হয়তো এখন বুঝতে পারেন অনেক কিছুই। অজানা ভবিষ্যতের শঙ্কায় চোখ খুলেই অঝোরে কাঁদতে থাকেন। সেই কান্না কাঁদিয়ে যায় মা-মামাসহ হাসপাতালের চিকিত্সকদেরও।

আফরীনের চিকিত্সার জন্য শুরুতে দরকার ছিল ১৫ লাখ টাকা। বাবা বাবুল তালুকদার ভালোবাসার একমাত্র মেয়েকে বাঁচাতে এই টাকা জোগাড় করার জন্য হাত পেতেছেন মানুষের কাছে। প্রথম আলোর অগণিত পাঠকসহ অনেকেই আবার আফরীনকে বাঁচাতে বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। বর্তমানে আফরীনের জন্য জমা পড়েছে পাঁচ লাখ টাকা। এছাড়া আরও একটি অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে প্রায় ৭০ হাজার টাকা। আফরীনকে বাঁচাতে মানুষের এই সাড়া পেয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন আফরীনের স্বজনেরা। এদিকে চিকিত্সকও জানিয়ে দিয়েছেন, আফরীন মোটামুটি একটি জটিল সময় পেরিয়ে এসেছে। তাই খুব বেশি নয়, আর মাত্র পাঁচ লাখ টাকা হলেই হয়তো বাঁচানো যাবে মেধাবী আফরীনকে।

‘আফরীনকে বাঁচানোর জন্য যা করা দরকার আমরা তাই করব। তারপরও চাই আমাদের মেয়েটা বেঁচে উঠুক। আবারও হাসুক। একবার তাঁর মুখে হাসি দেখতে চাই।’—কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন আফরীনের মামা আল-আমিন। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদেরতো অতো টাকা পয়সা ছিল না। তাই ঢাকায় এসে যখন শুনলাম ১৫ লাখ টাকা লাগবে, তখন সব আশা ছেড়ে দিয়ে আমরা আফরীনকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই হাসপাতালের ডাক্তারেরা খুব ভালো। তাঁরাই প্রথম বলেছিলেন, আফরীনকে অন্তত ৭২ ঘণ্টার জন্য হাসপাতালে রেখে দিন। একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখি। তারপর না হয় তাঁকে নিয়ে যাবেন। ডাক্তারের কথায় আফরীনকে এখানে রেখে দেই। সেই থেকে তাঁর চিকিত্সা চলছে। এখানে চিকিত্সকদের কোনো অবহেলা নেই। আফরীন যদি বেঁচে যায় তাহলে এখানকার ডাক্তারের চেষ্টা আর মানুষের সহযোগিতায় সে বেঁচে উঠবে।’

আয়েশা মেমোরিয়াল বিশেষায়িত হাসপাতালে আফরীনের  চিকিত্সক কাজী রফিকুল আলম জানান, ‘শুরুতে যখন আফরীন এখানে আসে তখন তাঁর অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। বর্তমানে আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে সে। তবে আফরীন অনেক ভয় পায়। এ কারণেই তাঁকে আইসিইউ থেকে বের করা যাচ্ছে না। আমরা চেয়েছি আফরীনকে আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে। যদিও টাকাটা এখানে মূখ্য, তারপরও আমরা ভেবেছি যেমন করে হোক আগে তাঁকে সুস্থ করা চাই। এমন একটা মেধাবী মেয়ে শুধু টাকার কাছে হেরে যেতে পারে না। তাই এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছি। জনগণের সহযোগিতা আর আল্লাহর করুণায় হয়তো সেরে উঠবে আফরীন।’

আফরীনের আরেক চিকিত্সক আবদুল ওয়াদুদ বেগ বলেন, শুরুতে আফরীন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ছিল। পরে সেটা সংক্রমিত হয়ে আজকের এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। প্রথম দিকে তার রোগটা ভয়ানক হলেও আফরীন এখন কিছুটা উন্নতির পথে। চার-পাঁচবার তাঁর কিডনি ডায়ালাইসিস করানো হয়েছে। আফরীনকে নিয়ে এখনও শঙ্কা কিন্তু রয়েই গেছে। তবে সম্ভাবনাটাও কম নয়।’

আফরীনের খবর প্রকাশের পর দেশ-বিদেশ থেকে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। প্রতিদিনই কেউ না কেউ সরাসরি হাসপাতালে গিয়ে আফরীনের চিকিত্সার জন্য টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। কেউবা নিচ্ছেন তাঁর খোঁজ-খবর। এভাবেই আফরীনের জন্য হাসপাতালেই জমা পড়েছে পাঁচ লাখ টাকা। আর ‘মো. শাহ আলম, হিসাব নম্বর-টি-১৪২৮, সোনালী ব্যাংক, কলাপাড়া বন্দর শাখা, পটুয়াখালী’ এই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে ৭০ হাজার টাকা। এখন আর মাত্র পাঁচ লাখ টাকা হলেই আফরীনের জন্য টাকার চিন্তাটা কমে যাবে তাঁর বাবা-মার। আর এতেই হয়তো বেঁচে যেতে পারে আমাদের সবার আফরীন।

আফরীনকে টাকা পাঠানোর ঠিকানা—মো. শাহ আলম, হিসাব নম্বর-টি-১৪২৮, সোনালী ব্যাংক, কলাপাড়া বন্দর শাখা, পটুয়াখালী। খন্দকার সাইফুল, হিসাব নম্বর-৪০০৫১২১০০০৫৪৮১৫, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, বৈদেশিক বাণিজ্য শাখা, ঢাকা এই ঠিকানাতেও পাঠাতে পারেন সাহায্য। এছাড়া ০১৭১৬৫৫৪৬৫০ এই নম্বরে আফরীনের মামা আল-আমিনের সঙ্গে এবং ০১৭২১৫৩৯৯২৬ এই নম্বরে আফরীনের বাবা বাবুল তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগও করা যাবে।

‘আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি-আপনারা আমার মেয়েটারে বাঁচান। এতো টাকা আমি কই পামু। আপনারাই একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে আফরীনকে বাঁচাতে পারেন।’ আফরীনের মা হেলেনা আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন এসব কথা। তারপর আর কোনো কথা বলতে পারেননি তিনি।

[ লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো’র অনলাইন সংস্করণে গত ১০ জুন ২০১২ তারিখে আমার কেতাবি নামে প্রকাশিত ]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান