আর্কাইভ | গল্প RSS feed for this section

মেঘরঙা শাড়ি

10 ডিসে.

সুলেখার আয়ু যে খুব বেশিদিন নেই তা খুব ভালো করেই জেনে গিয়েছিল সহিমুদ্দি। সুলেখা পোয়াতি হওয়ার সময় তার বুকে যে রোগটা বাসা বেধেছিল তা থেকে যে নিস্তার নেই, এটাও তাঁর জানা। তারপরও অল্প বয়সে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে মাসের পুরো আয়টাই ব্যয় করছে সুলেখার চিকিত্সার পেছনে। যদি ভালো হয় এই ভেবে। যদিও জানে এ কথায় তেমন একটা বিশ্বাস করা চলে না। তারপরও কথাটিকে আঁঁকড়ে ধরে থাকতে ভালোই লাগে সহিমুদ্দির। মনে মনে ভাবে বউ হিসেবে না হোক মেয়েটার মা হিসেবে তো কিছুদিন বেঁচে থাকবে। এতেই সে সুখ খুঁজে পায়।

সুলেখার ওপর মাঝে মাঝে ভিষন রাগও হয় সহিমুদ্দি। এক বেলা খেয়ে না খেয়ে কী চলা যায়? মাসের পুরো টাকাটাই তো চলে যায় সুলেখার পেছনে। সহিমুদ্দির যে চাল চুলো নেই তা কিন্তু নয়। চুলো আছে কিন্তু যে টাকা পায় তা দিয়ে হাঁড়ি চলে না প্রতিদিন। তার ওপর আবার ওষুধ পথ্য। তাও গত সপ্তাহ থেকে সুলেখা একেবারেই কাবু হয়ে গেছে। শরীর বিছানা এক করে ফেলেছে। কিন্তু সহিমুদ্দির যে এর বেশি কিছু করার সাধ্য নেই। এই হলো সহিমুদ্দির সংসার। একে ঠিক সংসার বলা যায় কি না তা তাঁর জানা নেই।

বিয়ের পর থেকেই সুলেখা একটা মেঘরঙা শাড়ি চেয়েছিলো। কিন্তু গত উনিশ বছরেও সেই শাড়ি কিনে দিতে পারে নি সহিমুদ্দি। কিন্তু সাধ আর সাধ্যের হিসেবটা ঠিক গুণতে পারে না সে। এই নিয়ে মাঝে মাঝেই চিত্কার চেঁচামেচি করে সুলেখা। তখন খুব বিরক্ত হয় সহিমুদ্দি, আবার খুব কষ্টও হয় তাঁর।

 

০২

সহিমুদ্দি গাঁয়ের পাশের জয়রাম ওঝা স্কুলের দপ্তরী। রোজ সকালে একটা ভাঙ্গাচোরা সাইকেলে করে এসে স্কুল ঘর পরিস্কার করা তাঁর প্রথম কাজ। তারপর হাতুরীটা নিয়ে ঢং করে ঘন্টিতে দেয় এক বাড়ি। শুরু হয়ে যায় স্কুল। এভাবে সারাদিনে পাঁচবার ঘন্টিটাতে বাড়ি মারতে হয় তাঁকে। এছাড়াও সারাদিন শিক্ষকদের ফুট ফরমায়েশও খাটতে হয়। পান থেকে একটু চুন খসলেই খেতে হয় হেডমাস্টারের চোখ রাঙ্গানী। এই করে মাসে বেতন আসে মোটে আড়াই হাজার টাকা। মাঝে মাঝে স্কুল কামাই করার কারণে বেতন থেকে টাকাও কেটে রেখে দেয় হেডমাস্টার। এ দিয়েই টাল মাটাল করে চলে সংসার আর চানুর মায়ের চিকিত্সা। সুলেখাকে এখন সহিমুদ্দি চানুর মা বলেই ডাকে। কতদিন বউয়ের আদর সোহাগ পায় নি সহিমুদ্দি। বউয়ের আদর সোহাগ প্রায় ভুলতেই বসেছে।

 

০৩

রোজকার মতো আজও দেরি করে স্কুলে এসেছে সহিমুদ্দি। আর দেরি হবেই বা না কেন! সেই সাত সকালে কাচা ঘুম ছেড়ে বিছানা থেকে উঠেই ছুটতে হয় ঋষি পাড়ার দিকে। তখন চারিদিকে শীত-কুয়াশার জোর হাওয়া। শুকানচকি গাঁয়ের মোড়টা একটু পেরিয়ে ঋষি পাড়ার একদম শেষ মাথায় কাঁইয়্যার বিল। সেই বিলে ভোর না হতেই মাছ ধরে জেলেদের দল। বিলের ধারে ঘাপটি মেরে বসে থাকে সহিমুদ্দি। বিল থেকে জেলেরা উঠে গেলে লুঙ্গিতে একটা মালকোছ দিয়েই তড়িঘড়ি করে নেমে পড়ে সে। কাদাখোঁচা পাখির মতো কাদার মাঝে হাতড়ে বেড়ায় মাছ। খানিক্ষণ হাতড়ানোর পর দু’একটি মাছ ধরা পরে হাতে। তারপর মুখে প্রশান্তির হাসি নিয়ে ঘরে ফেরে সহিমুদ্দি। কিন্তু ঘরে ফিরে যখন সেই মাছ কেটেকুটে রান্না করে আবার চানুর মাকে খাইয়ে দিতে হয় তখন মুখের সেই প্রশান্তির হাসি নিমিষেই ম্লান হয়ে যায়। তার ওপর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সুলেখার ক্যাচক্যাচানি অতিষ্ঠ করে তুলেছে সহিমুদ্দিকে। এমনিতে আজ ঘরে থাকতেই স্কুলের বেলা পেরিয়ে গেছে। তার ওপর আবার ক্যাচক্যাচানি। সবকিছু দেখে সরল সহিমুদ্দি আজ হিংস্র হয়ে ওঠে। এক ঝটকানীতে বিছানার ওপর থেকে ভাতের থালাটা ছুড়ে মারে বাইরে।  রাগে গজগজ করতে থাকে। সুলেখার দিকে ছুঁড়ে মারে বাক্যবাণ-‘মাগী মইরব্যার পাইস না। তুই মরলে ল্যাঠা চুকি যায়। এই জ্বালা মোর আর সইহ্য হয় না। সুখে থাকলে তোক ভুতে ধরি কিলায়, না!’ সুলেখা কিছু বলার আগেই ডালিম গাছে হেলান দেওয়া সাইকেলের প্যাডেলে পা দেয় সহিমুদ্দি। কিন্তু সাইকেলের চেইনটা কিছুতেই কথা শুনছে না আজ। রাগে অভিমানে দু হাত দিয়ে সাইকেলটা তুলে মাটিতে আছাড় মারে।  তারপর ভনভন করে স্কুলের দিকে হাঁটা শুরু করে সহিমুদ্দি। শেষমেষ স্কুলে যখন পোঁছালো তখন ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। সহিমুদ্দিকে দেখে হেডমাস্টার নলিনী বাবু আজ যেনো রেগেমেগে গোখরা সাপ হয়ে ওঠে।

‘কী ব্যাপার সহিমুদ্দি, এভাবে দেরি করে আসলে তো চলবে না। তুমি বাপু, না হয় অন্য কোনো কাজ খুঁজে নাও।’ নলিনী বাবুর প্রতিদিনের এই কথায় বেশ অভ্যস্থ হয়ে গেছে সহিমুদ্দি। কিন্তু আজ সেই কথাই যেনো চিরতার জলের মতোন মনে হয় তাঁর কাছে। কিছুতেই এই কথার ঢেকুর গিলতে পারছে না সে। তারপরও অনুনয় করে বলে, ‘স্যার ঘরোত রোগা মানুষটাকে কী করে ছাড়ি আসি। আর কয়দিন স্যার। সব ঠিক হয়্যা যাইবে। তাও কাজ থাকি বাইর করি দেন না স্যার।’ এ কথা বলতে বলতে চোখ দিয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ে সহিমুদ্দির। হেডমাস্টার নলিনী বাবুও সহিমুদ্দির কণ্ঠে এই কথা শুনেছে বহুবার। তাই আজ আর এই কথায় মন গলেনা নলিনী বাবুর। সময় হয়ে আসে স্কুলের আরেকটি ঘন্টি বাজানোর। চোখ মুছে ঘন্টি বাজানোর জন্য সামনের দিকে এগোতেই পাশের গাঁয়ের হরিপদ কোত্থেকে হুট করে এসে ঘন্টিটাতে ঢং করে দিয়ে দেয় এক বাড়ি। ঘন্টির এই বাড়ি আজ যেনো সহিমুদ্দির মাথায় গিয়ে আঘাত হানে। সেই আঘাতের রক্তপাতে পুরো হূদয় ভিজে যায় তাঁর। এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো হরিপদের মাথায় আজ সরিষার তেল চকচক করছে। গায়ে পরিপাটি জামা। সহিমুদ্দি নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে। মুখে কোনো কথা ফোটে না তাঁর। শুধু চোখ বেয়ে ঝড়ে পড়ে নিজের ওপর নিজের অভিমানের কান্না। হরিপদ ঘন্টিটা ঠিক জায়গা মতো রেখে একটা মুচকি হেসে সহিমুদ্দির খুব কাছ দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে যায়। হরিপদের চলে যাওয়ায় তাঁর মাথার সরিষার তেল আর কাপড়ে ন্যাপথলিনের গন্ধ বাতাসের হলকা এসে লাগে সহিমুদ্দির নাকে। সহিমুদ্দি বুঝতে পারে, এই গন্ধ তাঁকে আর এখানে থাকতে দিবে না। সহিমুদ্দি একবার আকাশের দিকে তাকায় আরেকবার নলিনী বাবুর দিকে। নলিনী বাবু মুখ ফিরিয়ে নেয়। হয়তো লজ্জা পায় নলিনী বাবু। ‘বাবু মুই গেনু। অ্যালা মনে হয় আর তোমার কাজের সময় নষ্ট না হইবে। ভালো থাকেন।’ এই কথা বলেই সামনের দিকে হাঁটা শুরু করে দেয় সহিমুদ্দি। স্কুলের গেট থেকে বের হয়ে আর কোনো রাস্তা খুঁজে পায় না সহিমুদ্দি। চোখের সামনে আজ সব কিছুই তাঁর অন্ধকার মনে হতে থাকে। ধীরে ধীরে আকাশের সূর্যটাও ঠিক মাথার ওপরে এসে হাজির হয়।

 

০৪.

ঢুলতে ঢুলতে সহিমুদ্দি জমসেদের চায়ের দোকানের বেঞ্চের ওপর এসে ধপ করে বসে পড়ে। জয়রাম ওঝা হাটের দুইটি নেড়ি কুকুর লেজ নাড়াতে নাড়াতে সহিমুদ্দির দিকেই এগিয়ে আসে। একটু পর কুকুরগুলো সহিমুদ্দির একদম গায়ের কাছেই চলে আসে। জিভ বের করে কিছুক্ষণ সহিমুদ্দির পায়ে কী যেন শুঁকতে থাকে কুকুরগুলো। তারপর তাঁর পায়ের কাছেই দুই পা বাড়িয়ে বসে পড়ে কুকুর দুটি। আর জিভ বের করে অনবরত হাপাতে থাকে। সহিমুদ্দি একমনে কুকুর দুটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবতে থাকে হাটের মধ্যে থাকা নেড়ি কুকুর গুলোর জীবন। এ ছাড়া যেনো আজ তাঁর আর কিছুই ভাববার নেই।

জমসেদকে এক কাপ চা দিতে বলে সহিমুদ্দি। খানিক বাদে চলটা ওঠা কাপে চা এগিয়ে দেয় জমসেদ। কাপে চুমুক দিতেই ওই দুর থেকে ভেসে আসা আজু পাগলার চিল-চিত্কার কানে এসে লাগে সহিমুদ্দির। আজু পাগলার চিত্কার স্পষ্ট বুঝতে পারে না। চায়ের কাপটা বেঞ্চের ওপর রেখে ভালো করে কান পাতে সহিমুদ্দি। একটু পরেই শুনতে পারে আজু পাগলা আকুলি-বিকুলি করে তাঁকেই ডাকছে। দৌড়ে কাছে এসে সহিমুদ্দিকে জড়িয়ে ধরে মুখের লালা ফেলতে ফেলতে আজু পাগলা বলতে থাকে, ‘ছইমুদ্দি তোল বউ মলি গেইতে। বালি য্যায়া দ্যাকেক।’ আজু পাগলার কথাটা খুব একটা গা করেনা সে। আজু পাগলা আগে ভালো ছিলো। বছর দুয়েক আগে তাঁর বউ খোদেজা জাদু টোনা করে আজুর ছোট ভাইকে বিয়ে করে পালিয়ে গেছে। সেই থেকে আজু আজ অব্দি পাগল।

জমসেদের চায়ের দোকানের বেঞ্চের ওপর পা দিয়ে এই সব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে পুরো জয়রাম ওঝা হাট ঘুরে আবারো আজু পাগলা ফিরে আসে সহিমুদ্দির কাছে। আবারো হাতটা ধরে টানতে টানতে বলে, ‘ছইমুদ্দি তোল বউ মলি গেইতে। বালি য্যায়া দ্যাকেক।’ এ কথা বলেই হাসতে থাকে আজু পাগলা। এইবার কেন যেনো বুকের ভেতরটা গুমরে ওঠে সহিমুদ্দির। সকাল বেলা অসুস্থ্য মানুষটাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এসেছে। এ কথা ভাবতেই সুলেখার জন্য মনটা কেঁদে ওঠে তাঁর। সটাসট জমসেদকে চায়ের দাম দিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় সহিমুদ্দি। ধীরে ধীরে আকাশের রঙও পাল্টাতে থাকে। এক সময় পুরো আকাশটাই কালো মেঘে ছেয়ে যায়। সহিমুদ্দির বুকের ভেতরে কেমন যেনো করতে থাকে। শুকানচকি গ্রামের ভেতরে ঢুকতেই সমবেত কান্নার ধ্বনি শুনতে পায় সে। দৌড়াতে থাকে সহিমুদ্দি। এক সময় পা হড়কে পড়ে যায়। কোনো দিকে না তাকিয়ে আবারো উঠে বাড়ির দিকে দৌড়াতে থাকে সহিমুদ্দি। বাড়িতে ঢুকতেই সহিমুদ্দি দেখে পাড়ার লোকেরা একে-দুয়ে এক উঠোন হয়ে আছে। চারিদিকের পরিবেশটা পোড়া ধুনের গন্ধ আর ধোয়ায় একাকার। দম বন্ধ হয়ে আসে তাঁর। একটু ভিড় ঠেলে ভেতরের দিকে এগোতেই চোখ পড়ে ঘরের চৌকাঠের কাছে শুয়ে থাকা সুলেখার দিকে। সহিমুদ্দি বুঝতে পারে সুলেখার নয় জয়ী হয়েছে মৃত্যুর। কোলের ওপর সুলেখাকে নিয়ে চোখ খুলে নির্বাক বসে থাকে সহিমুদ্দি। যেনো কোনো দিকে অপলক তাকিয়ে আছে সে। আজ আর তাঁর মুখে কোনো কথা ফোটে না। চোখেও আসেনা কোনো অশ্রুর বিন্দু।

০৫.

সহিমুদ্দির হূদয়ে এখন শোকপাথরের ঝড়। আস্তে ধীরে সম্বিত্ ফিরে পায় সহিমুদ্দি। দুপুর গড়িয়ে তখন নিভন্ত বিকেল। সুলেখাকে তুলে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় সহিমুদ্দি। ধীরে ধীরে সাদা কাপড়ে মোড়ানো সুলেখার দেহ মাটিতে শুইয়ে দেয় সে। মাটি চাপা দেওয়ার আগে আরও একবার দেখে নেয় সুলেখার নিথর দেহ। তারপরও অনেক্ষণ সুলেখার কবরের কাছে বসে থাকে। নিভন্ত বিকেলটাও এক সময় সুলেখার মতো হারিয়ে যায় সহিমুদ্দির দৃষ্টি থেকে।

নিশি হয়। জ্বলে ওঠে জোনাকীর দল। ওই দুরে ঢোলকলমীর বনের পাশ থেকে হাঁক ছাড়ে খেকশিয়ালের পাল। উঠে দাঁড়ায় সহিমুদ্দি। এবার ঘরে ফিরে যেতে হবে। সামনের দিকে হাঁটতে থাকে সে। আজ সহিমুদ্দির শোকে প্রকৃতিও কেমন কাতর হয়ে ওঠে। অন্ধকারে একলা সহিমুদ্দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় জোনাকীর ঝাঁক। ঘরে পৌঁছে কুপিটা জ্বালাতেই ঘরের ভেতরটা কেমন খা খা করে ওঠে। সহিমুদ্দির মনের ভেতরে যেনো আজ এক দগদগে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। কিছুই ভালো আগে না তাঁর। ঘরে কোনো খাবারও নেই। ঘরের কোণে রাখা মাটির হাঁড়ি থেকে এক গ্লাস জল খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ঘুম আসে না চোখে। শুধু ছটফট করতে থাকে। ভাবতে থাকে পুরনো দিনের কথা। এক সময় কত না রাত দুজনে এই বিছানায় খুনসুটি আর গল্পগাছা করে সময় কাটিয়েছে! কিন্তু আজ? এসব ভাবতে ভাবতে আর পাশ ফিরতে ফিরতেই ঋষিপাড়া থেকে কানে আসে শঙ্খের ডাক। বুঝতে পারে একটি রাত গত হয়ে গেছে।

 

০৬.

এভাবেই কেটে যায় দিন। কেটে যায় একেকটা রাতও। কিন্তু কাটতে চায় না সহিমুদ্দির অলস সময়। কেমন যেনো নিস্প্রাণ জীবন তাঁর। তারপরও একসময় উত্তাল নদীর বুকে জেগে ওঠে বিশাল চর। সেই চরে সবুজ জাগে। শরতে কাশফুলের শুভ্রতা দোল দিয়ে যায় চরের নতুন জীবনে। সহিমুদ্দির জীবনও এক সময় এমন হয়ে ওঠে।

 

০৭.

আজ ঘুম ভাঙ্গতেই চানুর কথা মনে পড়ে সহিমুদ্দির। মেয়েটাকে অনেকদিন দেখে না। বিয়ে করে চানু আর চানুর জামাই সেই যে দুর শহরে গেলো আর কোনো খোঁজ খবর নেই তাঁদের। মায়ের মরা খবরও শুনতে পারলো না বলে বড় আফসোস হয় তাঁর। তাঁদের সঠিক কোনো ঠিকানা জানে না সহিমুদ্দি। চানুর শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি অবশ্য তা জানে। চানুর শ্বশুড় বেশ ক’ বছর ধরে প্যারালাইসিসে ভুগছে। ওঠা-বসা করতে পারে না। দিন রাত মরা মানুষের মতো শুধু শুয়ে থাকে। আজ একবার চানুর শ্বশুড় বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে হয় তাঁর। এতে চানুর রোগা শ্বশুড়কেও দেখা হবে সেই সাথে চানুরও একটা খোঁজ পাওয়া যাবে। মনস্থির করে ফেলে সহিমুদ্দি, আজ ওখানে যাবেই। কিন্তু খালি হাতে কী করে মেয়ের শ্বশুড় বাড়ি যাবে! এই ভেবেই একটা বুদ্ধি খেলে যায় সহিমুদ্দির মাথায়। তারাতারি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। মুখে একটু পানি ছিটিয়েই দৌড় দেয় কাঁইয়্যার বিলের দিকে। জেলেরা উঠে গেলেই বিলে নেমে পড়ে সে। অনেক্ষণ হাতড়ানোর পর বেশ কিছু মাছ ধরে সহিমুদ্দি। তারপর এক ছুটে বাড়ি ফিরে আসে। অনেক দিন পর আজ যেনো তাঁর মনে একটা খুশি খুশি ভাব। কিছু মাছ একটা ব্যাগে ভরেই রান্না ঘর থেকে ভাঙাচোরা সাইকেলটি বের করে ডালিম গাছে হেলান দিয়ে রাখে। ঘর থেকে নারিকেল তেলের বাটিটি নিয়ে এসে চেইনসহ পুরো সাইকেলেই তেল দিয়ে ঘষতে থাকে। এক সময় সাইকেলটা দেখতে হরিপদের সরিষার তেল দেওয়া মাথার চুলের মতোন মনে হয়। দুপুরে গোসলটা সেরেই একটু ভাত আর মাছ উনুনে চাপিয়ে দেয় সহিমুদ্দি। ভাত মুখে দিতে দিতেই বিকেল গড়িয়ে আসে। আজ সহিমুদ্দিরও শখ হয় হরিপদের মতো মাথায় সরিষার তেল দেওয়ার। তারপর মাথাটা সাট করে চিরুনী করে বিড়ির আগুনে ফুটো হওয়া পাঞ্জাবীটা পড়ে নেয়। মাছের ব্যাগটা সাইকেলের হ্যান্ডেলে বেঁধেই রওনা দেয় তুলাতলি গ্রামের উদ্দেশ্যে।

তুলাতলি গ্রামেই চানুর শ্বশুড় বাড়ি। সাইকেলে ঘন্টা দুয়েকের পথ। পথে বারবার সাইকেলের চেইন তুলতে তুলতে প্রায় ঘন্টা তিনেক সময় লেগে গেলো। সহিমুদ্দি যখন চানুর শ্বশুড় বাড়ির বাহির উঠোনে পৌঁছালো তখন রাত নেমে এসেছে। ততক্ষণে সহিমুদ্দি ঘেমে নেয়ে একাকার। সাইকেলের বেলটা বাজাতেই বিয়ানি মানে চানুর শাশুড়ি বাইরে বের হয়ে আসে। অনেক দিন পর বিয়াইকে দেখে আনন্দিত হয়ে ওঠে চানুর শাশুড়ি। ঘরের বারান্দায় একটা টুল বের করে দেয় চানুর শাশুড়ি। সহিমুদ্দি সাইকেলটা রেখে বসতে বসতেই লবন আর গুঁড়ের শরবত এনে দেয় চানুর শাশুড়ি। শরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়ে নিজেকে একটু জিরিয়ে নেয় সহিমুদ্দি। কথা বলতে বলতে জানতে পারে চানু আর তার জামাই এখন ঢাকায় থাকে। গ্রামে তেমন একটা আসে না ওরা। তবে সামনের ঈদে আসবে মনে হয়। এবারে সহিমুদ্দি চানুর শ্বশুড়ের কথা শুনতে চায়।

‘মানুষটা কোনো কথা কয় না ব্যাহে। নইড়বার চইড়বারও পায় না। দিন রাইত ওই চালার নিচোত শুতি থাকে। আর চাইরোদিকে ফ্যালফ্যাল করি খালি দ্যাখে। ওই মানুষটাক নিয়্যা কী যে করিম, কিচুই বোঝোংচোল না। মানুষটা মরেও না’— কথাগুলো বলতে বলতে চোখ মোছে চানুর শাশুড়ি। সান্ত্বনা দেয় সহিমুদ্দি। বুঝতে পারে ঘরে একজন অসুস্থ্য মানুষ থাকলে তার কী জ্বালা। পাশের চালা ঘর থেকে চানুর শ্বশুড়কে দেখে আসে সহিমুদ্দি। ওই চালা ঘরটাতে কোনো বেড়া নেই। শুধু খোলা একটা চালার নিচে দিন রাত কাটায় চানুর শ্বশুড়। তাছাড়া আর উপায় কী? লোকটা যাবতীয় প্রাকৃতিক কাজও যে ওই চালা ঘরেই সেরে নেয়। ধীরে ধীরে রাত বেড়ে যায়। উঠতে চায় সহিমুদ্দি। কিন্তু বাধ সাধে বিয়ানি। আজ কিছুতেই তাকে যেতে দেবে না।

‘কী কন বিয়াই? অ্যালায় আইনেন আর অ্যালায় যাইমেন? ভাত খাও তারপর সারা রাইতে সংসারের গল্পসল্প করি সকালে উঠিয়া যান।’ চানুর শাশুড়ির এই কথাটা সহিমুদ্দিরও ভালো লাগে আজ। কতদিন গল্প করা হয় না! আজ না হয় একটু গল্প করেই সময়টা পেরিয়ে যাক। এ কথা ভেবে আর না করে না সে। টুলের ওপর বসে একটা বিড়ি ধরিয়ে নেয় এবার।

চানুর শাশুড়ি আঙ্গিনায় চুলার ওপর ভাতের হাঁড়িটা উঠিয়ে দিয়ে কলের পাড়ে মাছ কুটতে যায়। দুর থেকে কথা বলতে থাকে দুজনেই। চানুর শাশুড়ি আবার চুলার কাছে ফিরে আসে। পাশাপাশি বসে অনেক্ষণ ধরে দুজনেই কথার ভুশুড়ি ভাঙ্গতে থাকে। চানুর শাশুড়িও এ রকম গল্প অনেকদিন করে না। আর করবেই বা কী করে? বাড়িতে তো মানুষ বলতে ওরা দুজনেই। তার ওপর আবার চানুর শ্বশুড় আট নয় বছর ধরে কথাই বলতে পারে না। সারাদিন নিজের সাথেই কথা বলে। মাঝে মাঝে রাগ হলে ওই বোবা মানুষটার সাথে একটু আধটু চিত্কার চেঁচামেচি করে। তাই আজ যেনো বুকের মাঝে জমে থাকা এতো বছরের কথা গুলো উগরে দেয় সহিমুদ্দির দিকে। সহিমুদ্দি এক মনে চানুর শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। চানুর শাশুড়ি আজ মেঘের মতো নীলরঙা শাড়ি পড়েছে। যে শাড়ি সহিমুদ্দি ১৯ বছরেও সুলেখাকে কিনে দিতে পারে নি, সেই শাড়ি চানুর শাশুড়ির গায়ে দেখে খুব ভালো লাগে তার। চানুর শাশুড়ির শাড়িটা কল্পনায় সুলেখাকে পড়িয়ে দেয় সহিমুদ্দি। অবিকল সুলেখাকে দেখতে পায় সে। সেই আগের মতো। আবার বাস্তবে ফিরে আসে সহিমুদ্দি। আজ হুট করেই অনেক দিন পর সহিমুদ্দির মনের রাশ আলগা হতে থাকে। ধীরে ধীরে রাত গাঢ় হয় রাত। খাওয়া-দাওয়াও শেষ। এখন ঘুমোবার পালা। চানুর শাশুড়ি সহিমুদ্দিকে ঘরের ভেতর গিয়ে বিছানার ওপর শুয়ে পড়তে বলে চানুর শ্বশুড়কে ভাত খাওয়াতে যায়। কিন্তু এক ঘরে দুই জন থাকবে কী করে এই চিন্তায় পড়ে যায় সহিমুদ্দি। চিন্তাটা অবশ্য খানিক বাদে খোলাসা করে দেয় চানুর শাশুড়ি। সহিমুদ্দি থাকবে বিছানার ওপরে আর চানুর শাশুড়ি থাকবে মেঝেতে। এই বার চিন্তাটা একটু কমে যায় তার। শুয়ে পড়ে সহিমুদ্দি। একটু পর চানুর শাশুড়িও মেঝেতে একটা পাতার চাটাই পেতে শুয়ে পড়ে।

০৮.

অনেক দুর থেকে সাইকেল চালিয়ে আসায় শরীরটা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো সহিমুদ্দির। তাই বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম চলে আসে তার। কিন্তু চানুর শাশুড়ির চোখে ঘুম আসে না। চারিদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে ঘরের চালের ফাক গলে আসা চাঁদের আলো দেখতে বড় ভালো লাগে চানুর শাশুড়ির। ডাক দেয় সহিমুদ্দিকে—‘বিয়াই ঘুমাইছেন নাকি? উঠো ক্যানে। দ্যাখো চালার ফাক দিয়্যা কি সোন্দর চান্দের আলো দেখা যায়।’ চানুর শাশুড়ির ডাকে ঘুম ভাঙ্গে সহিমুদ্দির। বিরক্ত হয় হয় সহিমুদ্দি। না দেখার ভান করে বলে, ‘কই কিচুই তো দেখা যায় না। ঘুমানতো বিয়ানি।’ সহিমুদ্দিকে নিচে নেমে আসতে বলে চানুর শাশুড়ি। বাধ্য হয়ে বিছানা ছেড়ে নিচে নেমে চাটাইয়ের ওপর এসে বসে। ঘরের চারদিকের ভাঙ্গা বেড়া দিয়ে হু হু করে বাইরের হাওয়া ঢুকতে থাকে। শুয়ে শুয়ে আঙ্গুল দিয়ে চাঁদ দেখায় চানুর শাশুড়ি। চাঁদ দেখতে দেখতে হেলে পড়ে সহিমুদ্দি। শরীরের একটা অংশ ধাক্কা খায় চানুর শাশুড়ির শরীরে। দীর্ঘদিন বিরতির পর কামনা জাগে চানুর শাশুড়ির। জড়িয়ে ধরে সহিমুদ্দিকে। সহিমুদ্দি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়। কিন্তু চানুর শাশুড়ির মুখের ওপর চাঁদের আলো পড়ায় এক ধরণের মোহে পড়ে যায় সহিমুদ্দিও। কাগজের মতো সাদা হয়ে আসে সহিমুদ্দির মুখ। তবু জ্যোস্না রাতে জীবনের প্রথমবারের মতো আরও একবার দেহের কামনা বাড়ে সহিমুদ্দির। ধীরে ধীরে তার একটা হাত চানুর শাশুড়ির বুকের উপত্যকা বেয়ে নাভির তলদেশে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। নিজের ওপর রাখা বলগা একদম ছেড়ে দেয় চানুর শাশুড়ি। অতপর, চাঁদের আলোর নিচে শুরু হয় দুজনের উথাল-পাতাল প্রেম।

তুমি ভালো নেই দেখে মন ভরে যায়

24 ডিসে.

আশালতা রায়কে আজ বড্ড বেশি মনে পড়ছে। আশালতা রায়! ও, ও আমার বন্ধু ছিল। না না, বন্ধু ঠিক নয়। আমি ওকে বন্ধুবেসে ছিলাম। এটাকে ঠিক ভালবাসা বলে কী না, তা আমার জানা নেই।
আশালতার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল বাসে। গেল বসন্তে। ও আমাকে চিনতে পেরেছিল কী না সে প্রশ্ন এখানে উঠছে না। তবে আমি কিন্তু তাকে ঠিক ঠিক চিনতে পেরেছিলাম। আশালতার সেই হাত! যে হাতের তর্জনীতে একদিন পরম মমতায় পরিয়ে দিয়েছিলাম সোনার অঙ্গুরী। ক্ষয়ে গেছে, তারপরও সেই অঙ্গুরী আশালতা এখনও তর্জনীতে পড়ে আছে। ভারী সুন্দর লেগেছিল সেদিন আশালতাকে। আগে তাকে এমন সুন্দর মনে হয়েছিল কী-না, তা অনেকদিন আগের কথা। কত আগের কথা, তা আজ আর মনে পড়েনা।
বাসে আশালতাকে দেখে আমি নির্বাক দাঁড়িয়েছিলাম। আমার কী দোষ। ও যে দিনে দিনে এতো সুন্দরী হয়ে উঠবে তা কী আমি জানতাম না কি! বন্ধুকালেও মাঝে মাঝে এমন হতো। ওর কণ্ঠস্বরের আমি ভীষণ ভক্ত ছিলাম। আমি মুগ্ধ হয়ে ফোনে ওর কথা শুনতাম। আশালতা হ্যালো বললেই মনের ভেতর কেমন একটা প্রশান্তির ছায়া এসে ভর করতো আমার। আশালতাও আমার খুব ভক্ত ছিল। এটা অবশ্য আশালতার বলা কথা। তবে আমি বিশ্বাস করেছিলাম ঢের। আমার লেখা কবিতা ওর নাকি দারুণ লাগতো। আমি তখন রেডিও স্টেশনে। প্রতিরাতেই নিশি জেগে রেডিওতে আশালতা আমার আবৃত্তি শুনতো। আর আমি একটা কবিতা আবৃত্তি করে একটু থেমে থাকলেই অমনি ও ফোন করে বসতো আমায়। কী যে দুষ্টু ছিল না ও! তবে ওর দুষ্টুমিটাই কিন্তু আমার খুব ভালো লাগতো।
ক্যাম্পাসে মাত্র দুই টাকার বাদামের জন্য ও যা জেদ ধরতো না! আজ তা ভাবলেই অবাক লাগে। দু’টাকার বাদাম যখন ওর হাতে তুলে দিতাম তখন আশালতার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠতো। ভারী মায়াবী মনে হতো তখন আশালতাকে। মনে হতো, আশালতা যেনো মায়া দিয়েই গড়া এক মেয়ে। আশালতা কিন্তু ক্যাম্পাসে অনেক সুন্দরী মেয়ে ছিল। এজন্য সবাই আমাকে ঈর্ষা করতো। আবার সুবিধাও হয়েছিল একটা। সেটা হলো, আশালতার কারণে ক্যাম্পাসের সবাই আমাকে এক নামে চিনত। আমি কখনো ক্লাস থেকে নিচে নেমে এসে দেখতাম ও ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আমার ভবনের সামনের বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছে। আর এটা দেখে আমার বন্ধুরা খুব তোড়জোড় করতো, যে আমিও যেনো পরের ক্লাসগুলো ফাঁকি দিই। মাঝে মাঝে বন্ধুরা আমাকে আশালতার সঙ্গে ঘুরতে পাঠিয়ে দিয়ে তারা নিজেরাই ক্লাসে আমার হাজিরা খাতায় রোল নম্বরটা লিখে দিতো। বন্ধুরা যে আশালতার সঙ্গে আমাকে ঘুরতে দেখে কী আনন্দ পেতো তা আজও জানা হয়নি আমার। তবে আশালতা চলে যাওয়ায় আমি যতটা না কষ্ট পেয়েছি বোধ করি আমার বন্ধুরা তারও বেশি কষ্ট পেয়েছিল। এখন থাক সেসব কথা।
আশালতা সত্যি সত্যি খুব ভালোবাসতো আমায়। নইলে নিজের জীবন বাজী রেখে কী সেদিন আমায় গুলির হাত থেকে বাঁচাতে পারতো! শহীদুল্লাহ ভবনের দ্বিতীয় তলায়। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও আমাকে জাপটে ধরে শুয়ে পড়েছিল বারান্দার মেঝেতে। খানিকবাদেই আন্দোলনকারীদের দিকে লক্ষ্য করে পুলিশের ছোঁড়া একটি গুলি ঠিক আমার মাথার পাশে দেওয়ালে এসে বিঁধে গেল। সেদিন আশালতা কী বাঁচাটাই না বাঁচিয়েছিল আমাকে। উফফ্, ভাবলে এখনো গা শিরশির করে ওঠে।
এভাবেই হাতে হাত রেখে চলতে লাগল দিন। ঠিক বন্ধু কিংবা ভালবাসা নয় এটা। এটার নাম দেওয়া যেতে পারে ‘আমাদের সংসার’। কারণ, আশালতা তার নিজেকেই সপে দিয়েছিল আমার কাছে।
ক্যাম্পাস জীবনের শেষের দিকেই হবে হয়তো। ঠিক যখন আমাদের ক্যাম্পাসের বাইরের জগতে এসে সংসার সাজাবার কথা। তখনি কী নিয়ে যেনো ক্যাম্পাসে দারুণ এক দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেধে গেলো। শিক্ষার্থীদের ওপর নেমে এলো সেনাবাহিনীর নির্মম অত্যাচার। তত্ক্ষনাত্ বন্ধ হয়ে গেলো ভার্সিটি। হাজারো ভীড়ের মাঝে হারিয়ে ফেলি আশালতাকে। ফোনেও যোগাযোগ করে পাচ্ছি না তাকে। অবশেষে সবাই চলে গেলো নিরাপদ স্থানে। শুধু আমি ছাড়া। আমিতো আশালতাকে না নিয়ে যেতে পারি না! চরম বিপদের মধ্যে দিয়ে একটি রাত কাটলো হাজারো ভয়ঙ্কর রাতের কল্পনা নিয়ে। সেনাবাহিনীর বুটের শব্দে একটি ভয়ঙ্কর রাত ভোর হয়ে আসে। শুরু হয় আবারও উন্মাদনা। খানিক পরে জানতে পারি আশালতা তার এক বান্ধবীর সঙ্গে ভালোই আছে। স্বস্তি পাই মনে।
নিভন্ত দুপুর বেলা। কারফিউ কেবল শিথিল হয়ে এসেছে। এবারে আশালতা ও আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। সঙ্গে জুটলো আশালতার এক বান্ধবী। গিনি তার নাম। কিন্তু পকেটে আমার ফুটো পয়সাটাও আর অবশিষ্ট নেই। তারপরও আশালতার হাত ধরে কখনো দৌড়াতে দৌড়াতে কখনোবা বাসের চালককে অনুরোধ করে যখন আশালতার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালাম তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত একটা বাজে। হুট করে বাস চালক গোঁ ধরে বসলেন। সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন এতো রাতে এখান থেকে গাড়ি আর যাবে না। কী আর করা! বাধ্য হয়ে অপরিচিত এক বাড়িতে গিয়ে রাত কাটানোর আবদার করে বসলাম। কী মনে করে রাজিও হয়ে গেলেন ওই বাড়ির কর্তা। রাত কেটে ভোর হলো। ভোরে উঠেই রওনা হলাম আমার বাড়ির দিকে। তখন আশালতার দুচোখ বেয়ে নোনা জলের ধারা দেখেছিলাম। কষ্ট লেগেছিল খুব।
এবারে শুধু গিনি আর আমি। কিছুদুর যাওয়ার পর পকেট হাতড়িয়ে দেখি বেশ কিছু টাকা। মোবাইল বের করে দেখি আশালতার একটি বার্তা। তাতে লেখা-‘কিছু টাকা তোমার পকেটে গুজে দিয়েছি। পথে কিছু খেয়ে নিও। ভালো থেকো আজীবন। পারলে মনে রেখো।’ বার্তাটি পড়ে আমিও চোখের জলকে আর বাধা দিতে পারি নি। মনে হয়েছিল-এতো কেন ভালবাসে আশালতা আমাকে!
এরপর আর আশালতার সঙ্গে আমার ভালো করে কোনো দিন কথা হয়নি। তবে দেখা হয়েছিল একদিন। ক্যাম্পাসে। শুনেছি ও ইচ্ছের বিরুদ্ধে এক চিকিত্সককে বিয়ে করেছে। ও আরও সুন্দরী হয়ে উঠেছে। আশালতাকে সুন্দর দেখতে আমার ভালো লেগেছিল সেদিন। কিন্তু কেন যেন আমার নিজের চোখের জলের ভাষাগুলো বড্ড অপরিচিত মনে হয়েছিল সেদিন। আজও তা জানতে পারি নি। আর আশালতার চোখে সেদিন দেখেছিলাম ভয় আর কষ্টের অপরিচিত অথচ অপূর্ব এক রূপ। এরপর আশালতাকে আর দেখিনি। মানে আশালতাই আসেনি বলেই হয়তো দেখিনি। কিন্তু প্রতিরাতেই আমি আশালতার সঙ্গে কথা কই। ও হাসে। আচ্ছা, আশালতারও কী এমন হয়? খুব জানতে ইচ্ছে করে, একদিন নিজের কানে শুনবো ও কেমন আছে?
তারপর….তারপর দীর্ঘ কয়েক বসন্ত পর গেল বার বাসে তার সঙ্গে দেখা। তাকে দেখে কেমন কেঁপে উঠেছিল শরীর। কথা হয়নি। চোখাচোখি মাত্র। কিন্তু তার চোখের নিচের কালি বলে দিয়েছিল যে, সে ভালো নেই। এরপর আসলে কেউ ভালো থাকতে পারে না।
দীর্ঘ কয়েক বছর পর সেদিন অমিত এসেছিল আমার কাছে। কয়েক ঘন্টা গল্প করেছিল। সারা ঘর সিগারেটের ধোয়ায় ধূসর করে দিয়ে তার জীবনের এই গল্পটিই আমাকে শুনিয়েছিল আর অঝোর ধারায় কাঁদছিল। আমি সেদিন অমিতকে কোনো সান্ত্বনা দিতে পারিনি। ও অনেক বেশি বদলে গেছে। ক্যাম্পাসের মেধাবী ছেলেটি এখন কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছে। তবে কবিতা তাকে ছাড়েনি। একটি পত্রিকা অফিসে অন্যের কবিতা ছাপানোর জন্য বাছাই করে অমিত। মানে কেরানীগিরি করে। তবে যাই হোক, অমিতের কষ্টটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম ঠিকই।
আমার কাছ থেকে বিদায় নেবার আগে একটি চিরকুটে কোনো এক কবির কবিতার কয়েকটি লাইন লিখে গিয়েছিল অমিত —
‘বহুদিন পরে দেখা এক ডালিয়ায়
আশা করি ভালো আছ আশালতা রায়,
এ জগত্ নির্দয়- তাই ভালো থাকা দায়
তুমি ভালো নেই জেনে
মন ভরে যায়।’

আমার আজও জানা হয়নি আশালতার ভালো না থাকায় কেন অমিতের মন ভরে যায়। 

আত্মজৈবনিক

23 ডিসে.

আমার আমিত্ব যাবে অধো :পাতে , চন্দ্রালোক নীলবন
তাকে কভু মোহিত করবেনা | কেবল হোচট খাবে
রাস্তায়
সিড়িতে
ড্রইং রুমে
সমভূমি মনে হবে বন্ধুর পাহাড়
উল্টে পা হড়কে পড়ে যাবে
নিচে
আরও নিচে
ময়লার ড্রেনে
প্রতি বস্তুর দ্রোহ তার দেহ সারাক্ষণ করবে মথিত
সে ভয় পাবে
হাতছানি
কালো চোখ
উড়ন্ত কুন্তল
তাকে ভিত করে যাবে অভিসারী প্রতিটি বিকেল
দৃশ্য তাকে করবে অন্ধ
সুর তাকে করবে বধির |

সে আত্মহত্যা করবে
কালো রিভালবর
মধ্য রাতে ছাদ
ভর বেলাকার রেলগাড়ি
তার স্বপ্নদল যা সে কুরিয়ে এনেছে ঘুমের ভেতর থেকে –

সে বেরুলেই সূর্য নেভে
বৃষ্টি নামে কাঁটা তারের মতন
নষ্ট হয় রাজপথ , শহর , বন্দর , গ্রাম সারা বাংলা
তার অভিসারের দিন হটাত ঘোষিত হয় পুরনো দিবস হরতাল
সে রিকশায় উঠলেই টায়ার ফাটে
চৌরাস্তার নষ্ট লাল বাতি
চারিদিক চমকে দিয়ে আচমকা জলে উঠে
তার কারণেই
লাস্সোময়ী তরুনীর গর্ভে রুগ্ন হয়
প্রথম সন্তান
পুস্প প্রিয় শান্ত মালির চোখে বিবর্ণ গোলাপ ঝরে যায়
রুগ্ন হয় ইলিশ বোঝাই নদী , রুই কবলিত দিঘি ; জীর্ণ
হয় রসময় বৃক্ষ , নগরীর রূপসীরা –
অদিতীয় ,
দুষ্ট ,
মারাত্মক বাধি,
অভিচারী ,
নিজেক সর্বত্র করে তোলে প্রিয়
সুস্ত যদি এখন শরীর , ভয়াভহ বাধিগ্রস্থ হয়ে থাকি আমি ,

ও আমার আত্মা , সমগ্র ভুভাগ | সুস্থতা নেই দিবসের
সূর্যতলে , রাত্রির চাদের নিচে , জলেস্থলে | স্বপ্নে আসেনা পরীরা |
স্বপ্ন ও ভাসেনা অন্ধ চোখে | প্রকাশ্য রাস্তায় দিবালোকে , যত্র তত্র
সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করি কিশোরী কুমারী | যেনো আমি কফিনের থেকে
তুলে আনি কুষ্ট রোগ গ্রস্ত এক -একটি শরীর | এখন সর্বদা
রুগ্ন বোধ হয় সবকিছু ; গ্রন্থ , দর্শনার্থী , ঐতিহ্য , সভ্ভতা
এক
অসুস্থ সভ্ভোতা
দুরারোগ্য , পড়ে আছি নর্দমার তটদেশে
পাশের বস্তিতে নাচে আধ -নেংটো বিক্ক্রত রুগ্ন পরীরা |