আর্কাইভ | তরজমা RSS feed for this section

গাড়িতেই বাড়ি !

1 জুলাই

সু জ ন সু পা ন্থ

একটু আরাম-আয়েশে বসবাস করার জন্য বাড়ি-গাড়ির কথা ভাবেন না এমন মানুষের খোঁজ মেলা ভার। তবে, যারাই এই ভাবনা ভাবেন না কেন-আগে মাথা গোঁজার ঠাঁই বাড়ি তারপর ভাবেন গাড়ির কথা। কিন্তু এবারে একটু ভিন্ন ভাবনার মানুষের গল্প শুনি। যারা কিনা বাড়ির আগে গাড়ি কিনে ফেলেছেন। তাহলে তাঁরা থাকেন কোথায়? এ প্রশ্ন আসতেই পারে। একটাই উত্তর, ওই গাড়িই তাঁদের বাড়ি।

একটু আলাদাভাবে ভেবেই বাড়ির আগে গাড়ি কিনে ফেলেছেন যুক্তরাজ্যের ক্যান্টারবেরি শহরের ড্যানিয়েল বন্ড ও স্ট্যাসি দম্পতি। ২৮ বছর বয়সী ড্যানিয়েল বন্ড পেশায় গাড়ি মেরামতকারী। এই কাজ করে তিনি যে পরিমাণ অর্থ জমিয়েছেন তা একটি বাড়ি কেনার জন্য মোটেও যথেষ্ট ছিল না। কিন্তু স্ত্রী স্ট্যাসিকে (২০) নিয়ে একটু নিরাপদে থাকতেও হবে তাঁকে। এ নিয়ে বেশ ভাবনায় পড়ে যান তিনি। বাড়ি কেনার জন্য ব্যাংকও রাজি হয়নি ঋণ দিতে। আর অন্যের বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে নারাজ দুজনেই। তাই বাধ্য হয়ে দুজনে মিলে শলা-পরামর্শ করে একটি বড়সড় গাড়ি কেনার কথা ভাবেন। তাঁদের ভাবনার কথা শুনে ড্যানিয়েলের মা তাঁকে ‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে’ বলে ড্যানিয়েলকে রাগারাগিও করেছিলেন। সেই চোখ রাঙানিকে থোড়াই কেয়ার করে নিজেদের সিদ্ধান্তেই অটল থেকেছিলেন তাঁরা। তাঁদের চাওয়া এমন একটি গাড়ি, যাতে সারা শহর মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ানো যাবে, সেই সঙ্গে খাওয়া-দাওয়াসহ গাড়ির ভেতরে একটু নিরাপদে ঘুমানোও যাবে। যেই ভাবনা সেই কাজ। অর্থকড়ি গোছগাছ করে তিন হাজার পাউন্ড দিয়ে গত বছরের অক্টোবরে লেল্যান্ড অলিম্পিয়া-১৯৯১ মডেলের একটি দ্বিতল বাস কিনে ফেলেন তাঁরা। এরপর আট হাজার পাউন্ড বাড়তি খরচ করে সেই বাসের ভেতরে দুইটি থাকার কক্ষসহ বাড়ির মতো করে বানিয়ে নিয়েছেন ড্যানিয়েল ও স্ট্যাসি দম্পতি। এখন তাঁরা সেই বাড়ি মানে গাড়িতেই থাকেন, ঘর-সংসার করেন।

বাসটির ভেতরে এখন তাঁদের থাকার জন্য দুইটি কক্ষ, একটি রান্নাঘর, টেলিভিশন কক্ষ, প্রসাধন কক্ষ, পানির ট্যাঙ্ক এমনকি একটি বারও আছে।

‘শুরুতে আমরা বাড়ি নিয়ে বেশ হতাশায় পড়েছিলাম। ক্যান্টারবেরিতে ছোট্ট একটি ফ্ল্যাট কিনতে প্রায় এক লাখ পাউন্ড দরকার। অতো অর্থ আমাদের ছিল না। কিন্তু টাকা খরচ করে অন্যের বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকারও ইচ্ছে ছিল না আমাদের। তাই অল্প অর্থ খরচ করে গাড়ি কিনে তার ভেতরে বাড়ি বানিয়ে থাকার কথা চিন্তা করি। প্রথমে বেশ জটিল মনে হলেও পড়ে বুঝতে পারি এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে সহজ সমাধান।’—বলছিলেন ড্যানিয়েল বন্ড।

ড্যানিয়েল-স্ট্যাসির গাড়ির ভেতর বানানো এই বাড়িতে প্রায় ২২০ লিটার পানি ধারণ করার মতো ট্যাঙ্ক রয়েছে। তাছাড়া সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের ব্যবস্থাও আছে গাড়িতে। রান্না ঘরের ভেতরে আছে চুলা, রেফ্রিজারেটর ও কিচেন ক্যাবিনেট।

স্ট্যাসি বলেন, ‘এটা আমার খুব ভালো লেগেছে। খুবই ভালো একটি উদ্যোগ। আমাদের একটি বাড়ির খুব প্রয়োজন ছিল। ড্যানিয়েল অনেক কষ্ট করেছে এজন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্থ জোগাড় করতে পারেননি। তাতে কী! এখন তো এটাই আমাদের দু’জনের নিজেদের বাড়ি।’

ড্যানিয়েল আরও বলেন, বাসটির ভেতরে ঢুকলে কেউ বলতে পারবে না যে, এটা একটা বাস। এটা আসলে পুরোদমে একটি নতুন বাড়ি।’

বাসটি বর্তমানে একটি খোলা জায়গায় রাখা আছে। তবে ড্যানিয়েল আশা করছেন, সামনের আগস্টেই তিনি গাড়িটির চালক হিসেবে লাইসেন্স পেয়ে যাবেন। আর তা হাতে পেলেই ওই বাড়িতুল্য গাড়িতে স্ট্যাসিকে নিয়ে ঘুরে আসবেন কর্নওয়েল থেকে। যেখানে কেটেছে তাঁর শৈশব, তাঁর কৈশোর। ওয়েবসাইট।

© [লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো’র অনলাইন সংস্করণে গত ৩০ জুন  ২০১২ তারিখে প্রকাশিত]

যে ছবি কথা বলে

2 জুন

রাজীব-সোনিয়া যখন আইসক্রিম খাচ্ছিলেন

দিল্লির ইন্ডিয়া গেটের সামনে আইসক্রীম হাতে রাজীব গান্ধী ও সোনিয়া গান্ধী

 

বাইরে বেশ গরম। এই গরমে ফাঁকা রাস্তার মোড়ে একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে আইসক্রিমওয়ালার কাছ থেকে আইসক্রিম নিয়ে তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন। সঙ্গে তাঁর সদ্য বিবাহিত স্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছেন, অথচ তাঁদের সঙ্গে কোনো নিরাপত্তারক্ষী নেই! এমনটা কি ভাবা যায় আজকের দিনে! মোটেও না। কিন্তু সত্তরের দশকের শুরুর দিকের একটি ছবিতে এমনই দেখা গেছে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ও তাঁর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধীকে। দিল্লির ইন্ডিয়া গেটের সামনে বেশ হাস্যোজ্জ্বলভাবেই তাঁরা ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। আর ইতিহাস হয়ে যাওয়া এ ছবিটি সে সময় ক্যামেরাবন্দী করার সুবর্ণ সুযোগটি পেয়েছিলেন আলোকচিত্রী বলদেব কাপুর। এমনই একটি ছবি ও তাঁর পেছনের কথা নিয়ে আজ শুক্রবার এনডিটিভি অনলাইনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

 

শুধু রাজীব-সোনিয়ার এমন একটি ঐতিহাসিক ছবি ক্যামেরাবন্দী করেই তৃপ্ত হননি বলদেব। বরং ভারতের তুমুল জনপ্রিয় এই গান্ধী পরিবারের একগাদা ছবি তুলে তিনি নিজেও ইতিহাস হয়ে আছেন আজ। শুধু তা-ই নয়, গত পাঁচ দশক ধরে নিজের ক্যামেরায় ভারতের ইতিহাস ক্যামেরাবন্দী করার মাধ্যমে তিনি বিখ্যাত আলোকচিত্রী হিসেবে নিজের নামটিও ইতিহাসে লিখে নিয়েছেন সন্দেহ নেই। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে দালাইলামা এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভারত সফরের মুহূর্তগুলোও ক্যামেরাবন্দী হয়ে আছে বলদেব কাপুরের ক্যামেরায়।

বলদেবের তোলা এসব ছবির এখন অনেকগুলোই বিভিন্ন ফটো এজেন্সিতে রাখা আছে। অনেকেই সেসব ছবি দেখে স্মৃতিও তাড়িয়ে বেড়ান। এসব ছবি এখনো কারও কারও চোখে সেই ইতিহাসকে জীবন্ত করে তোলে।

রাজীব গান্ধী ও সোনিয়া গান্ধীর সেই বিখ্যাত আইসক্রিম খাওয়ার ছবি প্রসঙ্গে বলদেব কাপুর বলেন, ‘এ ছবিটি তোলার পেছনে একটি লম্বা গল্প আছে। আর এটার সবটাই সম্ভব হয়েছে রাজীবের মা ইন্দিরা গান্ধীর সৌজন্যে। আমি জানি না, কীভাবে তিনি আমাকে খুঁজে বের করেন। তখন রাজীব ও তাঁর ভাই সঞ্জয় ছোট ছিলেন। তাঁদের মা একদিন তাঁদের ছোটবেলার ছবি তোলার জন্য আমাকে বললেন। তারপর থেকে শুরু। ইন্দিরা গান্ধী অবশ্য সেসব ছবি থেকে বাছাই করে একটি করে ছবি তাঁর ওয়ালেটে রেখে দিতেন। এর ঠিক ছয় মাস পর যখন রাজীব ও সঞ্জয় আরেকটু বড় হয়ে উঠেছেন ঠিক তখনই আবারও প্রধানমন্ত্রী বাসভবনে ছবি তোলার জন্য ডাক পড়ল আমার। আমি আবারও ইন্দিরা গান্ধীর ওয়ালেটে রেখে দেওয়ার মতো করে দুই ভাইয়ের ছবি তুলে দিলাম।’

এরপর রাজীব গান্ধী বড় হয়ে যখন রাজনীতিতে যোগ দিলেন তখন ভারত সরকার ও কংগ্রেস পার্টির কাছে তাঁর ছোটবেলার ছবিগুলোর ব্যাপক চাহিদা বেড়ে যায়। এ ছাড়া রাজীব গান্ধী যখন কোনো জায়গা সফর করতেন তখন তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই থাকতেন আলোকচিত্রী বলদেব কাপুর।

বলদেব জানান, ‘রাজীব গান্ধী খুবই সহানুভূতিশীল মানুষ ছিলেন। তিনি আমাকে বাইরে দেখলেই জিজ্ঞেস করতেন, আপনি খেয়েছেন? এখানে থাকার মতো জায়গা আছে তো আপনার?’

‘দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলের ইতালির একজন মেয়েকে বিয়ে করার বিষয়ে মানুষ আগ্রহী হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে গণমাধ্যমের আগ্রহও ছিল বেশ। এ সময় বেশ কিছু আলোকচিত্রী তাঁর বিয়ের ছবি তোলার জন্য পাপারাজ্জির মতো লেগে থাকত। কিন্তু এ রকম চুরি করে ছবি তোলা আমি পছন্দ করতাম না।’

একটি অনুষ্ঠানে স্রেফ চুরি করে সোনিয়া ও রাজীবের ছবি তোলার কারণে এক আলোকচিত্রীর ক্যামেরা কেড়ে নিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। এর কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছিলেন, কেন তাঁকে না জানিয়ে ছবি তোলা হলো। এ কারণেই ক্যামেরা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এ ঘটনা শোনার পর সেই অনুষ্ঠানেই বলদেব রাজীব গান্ধীর কাছে তাঁদের ছবি তোলার জন্য অনুমতি চান। তখন রাজি হয়ে যান রাজীব। ভাগ্যের ফেরে আরও কিছু ইতিহাস সেদিন ক্যামেরাবন্দী করার সুযোগ লুফে নেন বলদেব কাপুর।

এরপর একদিন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে সকাল থেকে রাজীব ও সোনিয়ার ছবি তোলা শুরু করেন বলদেব। ঘুরে ঘুরে দিল্লির চাঁদনী চক ও লালকেল্লায় তোলা হয় ছবি। বলদেব নিজেই চালাচ্ছিলেন গাড়ি। পেছনে বসা রাজীব-সোনিয়া দম্পতি। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তাঁর বউয়ের জন্য সঙ্গে কোনো নিরাপত্তারক্ষী ছিল না সেদিন। গরমও পড়েছিল খুব। গাড়ি যখন ইন্ডিয়া গেট পেরিয়ে যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে এক আইসক্রিমওয়ালাকে দেখে রাজীব গান্ধীকে আইসক্রিম খাওয়ার জন্য আহ্বান জানান বলদেব। সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যান রাজীব। এরপর রাজীব ও সোনিয়া গাড়ি থেকে নেমে আইসক্রিমওয়ালার একদম কাছে গিয়ে আইসক্রিম নিয়ে খেতে শুরু করেন। এমন সময় বেশ কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দী করে নেন বলদেব কাপুর।

এসব বিষয় সোনিয়া গান্ধী পছন্দ করতেন কি না জানতে চাইলে মৃদু হেসে বলদেব জানান, ‘সব সময় তিনি খুব লাজুক ছিলেন।’

এনডিটিভি থেকে অনূদিত

[লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো’র অনলাইন সংস্করণে গত ১ জুন  ২০১২ তারিখে প্রকাশিত]

হিটলারের অজানা কথা

18 এপ্রিল

হিটলার ল্যান্ড বইটির প্রচ্ছদ

‘জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর ফুয়েরার অ্যাডলফ হিটলারকে কখনো সামনে থেকে না দেখলেও আকস্মিকভাবে এত দিন পর এবার তাঁর খুব কাছে পৌঁছে যেতে পেরেছি, সামনে থেকে দেখেছি, স্পর্শ করেছি এমনকি তাঁর শরীরের গন্ধ পর্যন্তও আমি নিতে পেরেছি।’ দৃশ্যত না ঘটলেও এত ঘটনা যে ঘটল, তার সবটাই কিন্তু সম্ভব হয়েছে অ্যানড্রিউ নাগোরস্কির লেখা হিটলার ল্যান্ড বইটি পড়ে। বইটির ভেতর এত চমত্কার বুননে নাগোরস্কি হিটলারের বর্ণনা করেছেন, তা যেন চোখের সামনে ছবি হয়ে ভাসে। যেন মনে হলো দৃশ্যগুলো এই মাত্র আমার চোখের সামনেই ঘটে গেল। আর আমি তাঁর সাক্ষাত্ দর্শক-শ্রোতা।’ অ্যানড্রিউ নাগোরস্কির (নিউজউইকের সাবেক প্রতিনিধি) লেখা ‘হিটলার ল্যান্ড’ বইটির আলোচনায় এমনভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন আলোচক ক্রিস্টোফার ডিকি।

বইটিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময় থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকের অভিজ্ঞতাই তুলে ধরেছেন লেখক। আর এই লেখাই হিটলারকে একই সঙ্গে মানবিক, নিষ্ঠুর, প্রতিনিধি, কূটনৈতিক, ব্যবসায়ী, তোষামোদকারী ও সবশেষে একজন সৈনিক হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আমাদের কাছে।

আমেরিকার অনেকেই বিশেষ ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে। আর আমেরিকার এই সাংবাদিক বার্লিনে হিটলারের খুব কাছাকাছি যাওয়ার পুরো সুবিধাটাই যেন ভোগ করে নিয়েছেন।

সিবিএস রেডিওর কর্মকর্তা ইয়াং উইলিয়াম শিরের তাঁর ডায়েরিতে হিটলারকে নিয়ে নানা বিষয় লিখেছেন। ১৯৩৮ সালে মিউনিখ কনফারেন্সের আগের দিন হিটলার যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা-ও দেখেছিলেন তিনি। কোনো ধরনের সহিংসতা ছাড়াই চেকস্লোভাকিয়া থেকে জার্মানিকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সমর্থন করেছিল বলে ওই বক্তব্যে দাবি করেছিলেন হিটলার।

ইয়াং উইলিয়াম শিরের তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, বক্তব্য দেওয়ার সময় হিটলারকে বেশ বিচলিত মনে হচ্ছিল। আর এসবই খুব কাছ থেকে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখেছিলেন তিনি। বক্তব্য দেওয়ার পুরো সময়টাই হিটলার বারবার তাঁর কাঁধ ঝাঁকাচ্ছিলেন।

‘সামনের দিকে থাকা দর্শক-শ্রোতারা কিন্তু এসবের কিছুই দেখতে পায়নি। কিন্তু আমি তা দেখতে পেয়েছিলাম ঠিকই। প্রথমবারের মতো আমি তাঁকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে বুঝতে পারি, আজ হিটলার তাঁর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছেন।’ ডায়েরিতে এভাবেই লিখেছেন উইলিয়াম শিরের।

চা চক্রে হিটলার

হিটলারের জয়ের ঠিক কিছুদিন পরই শিরের দেখলেন, একটা হামবড়া ভাব চলে এসেছে তাঁর আচরণে। খিঁচুনি ভাবটা চলে গেছে।

হিটলারের সঙ্গে অপ্রত্যাশিতভাবে সবচেয়ে বেশি যাঁদের সামনা-সামনি দেখা হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন আমেরিকার নারী। ১৯২০ সালের শুরুর দিকে নিউইয়র্কে হেলেন নেইমার নামের এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। হেলেন নেইমার ছিলেন আর্নেস্ট পুতজি নামের জার্মান-আমেরিকান এক কূটনীতিকের স্ত্রী। তিনি পুতজি নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। পরে অবশ্য পুতজি হিটলারের ব্যক্তিগত উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন।

হেলেন নেইমার পরে বলেছিলেন, তাঁর নািস নেতা নপুংসক ছিলেন। কিন্তু হিটলার তাঁর সঙ্গে অনেক বেশি সময় কাটাতে চাইতেন। ১৯২৩ সালের দিকে ব্যাভেরিয়ার সরকারের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা যখন তাঁর ব্যর্থ হলো, তখন হিটলার পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। পরে অবশ্য হেলেন নেইমারের ঘরে দুজন একসঙ্গে ধরা পড়েছিলেন।

এরপর নিজেই নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হিটলার বলেছিলেন, ‘এখন সব কিছুই হারিয়েছি—বাকি আর কিছু নেই!’ এ সময় পিস্তলসহ হিটলারের হাত ধরে ফেলেছিলেন হেলেন। সে সময় জার্মানদের মধ্যে যাঁরা হিটলারের আদর্শকে বিশ্বাস করেন, তাঁদের কথা মনে করিয়ে দিয়ে হেলেন বলেছিলেন, ‘আপনি যা করছেন, তা কি ভেবে দেখেছেন? আপনার সামনে এগিয়ে যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে তাঁরা।’ এভাবেই হিটলারের কাহিনিগুলো লিপিবদ্ধ হয়েছে অ্যানড্রিউ নাগোরস্কির ‘হিটলারল্যান্ড’ বইটিতে।

এরপর কারাগার থেকেই হিটলার লিখেছিলেন বিখ্যাত বই ‘মেইন ক্যাম্প’। গ্রেপ্তার হওয়ার প্রায় এক দশক পর সত্যিকার অর্থে ক্ষমতা পেয়েছিলেন হিটলার।

সময়গুলো বদলে গিয়েছিল কিন্তু তার পরও হিটলারের পাশেই ছিলেন সেই হেলেনের স্বামী পুতজি। হিটলারের একনায়কত্বের প্রথম বছর পর্যন্ত সব দৃশ্যেই তিনি ছিলেন। এ সময় পুতজি হিটলারের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সুন্দরী মেয়ে মার্থা ডডের পরিচয় করিয়ে দেন। হিটলারের ওই মুহূর্তে একজন নারীর প্রয়োজন। আর হিটলারের এই প্রয়োজনের কথাটি পুতজি সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন মার্থাকে। এরপর অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে বার্লিনের একটি হোটেলে হিটলারের সামনে মার্থাকে উপহার হিসেবে নিয়ে আসেন পুতজি। কিন্তু এই ঘটনা আগে থেকে ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি হিটলার। একান্তে সামনে পেয়েই মার্থার হাতে চুমু দিলেন হিটলার। মিনমিন করে কী যেন বলে আবারও তাঁর হাতে চুমু দিলেন তিনি। এরপর সেই দিন পুরো সময়টা মার্থার সঙ্গে অতি উত্সাহ আর অস্বস্তি নিয়ে কাটিয়েছিলেন হিটলার।

এমনই সব কাহিনি রূপায়িত হয়েছে পুরো বইটিতে। অসম্ভব সুন্দর উপস্থাপনায় যেন পুরো বিষয়টিই একটা চিত্রকল্প। বইটির শেষে এসে আরও বিস্মিত হতে হয় পাঠকদের। প্রশ্ন উঠতে পারে, হিটলার যদি সে সময় আত্মহত্যা করতেন, তাহলে কী হতো? আমেরিকার এই প্রত্যক্ষদর্শী লেখক কী গোটা দুনিয়ায় হিটলারের এই পাগলামো লুকাতে পারবেন? যদি তা না পারেন, তাহলে কী হবে? কিন্তু প্রকৃত অর্থে তাঁরা যা দেখেছেন, এই ইতিহাসে তার পুরো একটা নির্যাসই যেন ফুটে উঠেছে দারুণভাবে।

নিউজ উইক থেকে অনূদিত

[লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো’র অনলাইন সংস্করণে গত ১৭ এপ্রিল ২০১২ তারিখে আমার কেতাবি নামে প্রকাশিত]