শৈশবেই হারিয়ে ফেলেছি জলেশ্বরীর সুর, সেই সুর বিহীন আমার সব গানই এখন নিষ্প্রাণ। বহুদিন পর কাল স্বপ্নে দেখেছি- জলেশ্বরী তোমার ঠোঁটে লেগে আছে আজও শিশুমালতির ঘ্রাণ…
(ঠোঁটে তাঁর শিশুমালতির ঘ্রাণ—সুজন সুপান্থ)
শিশুমালতির নাম শুনলেই শৈশবে চকচক করে চোখের সামনে ভেসে উঠতো ছোট্ট একটা মলমের কৌটো। শীতে ঠোঁট ফেটে গেলে ওই শিশুমালতির শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া তখন আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। লাল রংয়ের মলমের মতো দেখতে অনেকটাই। ছোটবেলায় ওই একটা শিশুমালতি কিনে হাফপ্যান্টের পকেটে রেখে পাড়ার সবার সামনে পালোয়ানি দেখাব বলে, কত না চেষ্টা করেছিলাম। এক টাকা দামের ওই শিশুমালতি কিনব বলে কত দিন থেকে যে স্বপ্ন দেখতাম! অবশ্য সেই স্বপ্ন খুব কমই পূরণ হতো আমার। পূরণ হতো না বাবা কিনতে দিতেন না বলেই। কিন্তু আমাদের পাশের বাড়ির বাবলু আর নীলা মাসি যখন শিশুমালতি মেখে ঠোঁট দু’টো চকচক করে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসি দিতো তখন বুকের ভেতরে কেমন গুমরে উঠতো আমার। মনের অজান্তেই চোখের কোণা দিয়ে লেবুর রসের মতো কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়তো।
বুকের ভেতর গুমরে ওঠে শিশুমালতির নাম
শিশুমালতির প্রতি যে শুধু আমারই ঝোঁক ছিল, তা কিন্তু নয়। আমার বড়ভাইয়েরও একই রকম ঝোঁক ছিল। বিশেষত আমি ওটা কিনতে পারতাম না বলে ওর খুব মন খারাপ হতো। এটা আমি ঠিকই বুঝতে পারতাম। একবার রাতের বেলায় আমি আর আমার ভাই হ্যারিকেনের আলোর সামনে বসে ঘোঁট পাকিয়ে সিদ্ধান্তে আসলাম, আমরা আমাদের পুরোনো খাতাগুলো বিক্রি করে দেব। তারপরও ওই টাকা দিয়ে দু’জন দুইটা বড় শিশুমালতির কৌটা কিনব। পরদিন সকালে দুই ভাই মিলে আমাদের পুরোনো খাতা জমা করে দোকানে বিক্রি করে শিশুমালতি কিনে নিয়ে এসেছিলাম। ততদিনে বাবলুর শিশুমালতির কৌটা শেষ হয়ে গেছে। তাই আমরা ঠোঁটে শিশুমালতি মেখে বাবলুর সামনে গিয়ে মুচকি হাসতাম। তখন বাবলু কিংবা নীলা মাসির বুকের ভেতর গুমরে উঠতো কি না জানি না। আমার সেই ভাই এখন আর আমার মাঝে নেই। নীলা মাসি এখন পরের ঘরে। পরম মমতায় নিজের সন্তানদের ঠোঁটে শিশুমালতি বা অন্যকিছু লাগিয়ে দেন কি না জানি না। খোঁজ নেই বাবলুরও। শিশুমালতিও ঠোঁটে দেওয়া হয় না আর বহুকাল।
হারিয়ে ফেলেছি জলেশ্বরীর সুর
আমি জলেশ্বরীকে শিশুমালতির কথা বলিনি কোনোদিন। মানে, ঠিক মনে ছিল না বলেই হয়তো বলা হয়ে ওঠেনি। জলেশ্বরীর ঠোঁটও কিন্তু চকচক করতো। এক ধরনের মিষ্টি সুবাসও পাওয়া যেত মাঝে মাঝে। আঁঁচ করতে পারিনি, তবুও কেন যেন জলেশ্বরীর ঠোঁট থেকে ভেসে আসা ওই সুবাস আমার খুব পরিচিত, খুব আপন বলে মনে হত। মনে করার চেষ্টা করতাম, কিন্তু শেষমেষ তা আর হতো না। বুকের ভেতর কষ্ট হতো। ওই কষ্টের কথা জলেশ্বরী বোধহয় ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি কোনোদিন।
খুব ইচ্ছে হতো জলেশ্বরীর ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে আমার ঠোঁটে ওই সুবাস মেখে নিই। কিন্তু সে সাহস হয়নি কখনো। কল্পনায় অনেকবার সাহস করেছিলাম। কিন্তু সে অধিকার আমার ছিল কি না এই তথ্যটুকুও আমার জানা ছিল না তখন। অথচ সেসময় আমার প্রতিটি কথা গান হয়ে জলেশ্বরীর সুরেই বেজে উঠতো প্রতিনিয়ত।
জলেশ্বরী আমাকে কী ভেবেছিল সে প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু আমি তাঁকে জলেশ্বরীরও অধিক ভেবেছিলাম। হয়তো সেও ভেবেছিল কিংবা ভাবতো না বোধ হয়। তাঁর ভাবনাটা জানতে পারিনি কখনো। চেষ্টা করেছিলাম। হঠাত্ এক মাছরঙা বিকেলে প্রথম জলেশ্বরীর ঠোঁটের খুব কাছে গিয়েছিলাম আমি। সেদিনও জলেশ্বরীর ঠোঁটে শিশুমালতির গন্ধ পেয়েছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে এখনও। তারপর ওই ঠোঁটের কাছে আর যাওয়া হয়নি কখনো। কারণ, সেই মাছরঙা বিকেলেই কোনো কিছু না বলে জলেশ্বরী থামিয়ে দিয়েছিল তাঁর সুর। নির্বাক আমি তাকিয়ে দেখেছি—জলেশ্বরী আলো জ্বলা পাখিদের মতো আলো জ্বেলে জ্বেলে চলে যাচ্ছে দূরে বহুদূরে। যেতে যেতে মিলিয়ে যায় এক সময়। আর চোখের সামনে ভেসে ওঠে সন্ধ্যার বিশাল আকাশে জ্বলজ্বলে একটি তারা।
ঘরজুড়ে শিশুমালতির ঘ্রাণ
বহুদিন পর কাল রাতে জলেশ্বরী এসেছিল। আমার ঘর জুড়ে শিশুমালতির ঘ্রাণ পেয়ে আমি ঠিকই বুঝেছিলাম জলেশ্বরীই এসেছে দূর হতে আমাকে দেখতে। ও হয়তো আগের মতই আছে। সেই চকচকে ঠোঁট, ঠোঁটে শিশুমালতির ঘ্রাণ। তা না হলে আমার ঘরে তাঁর ঠোঁটের ওই সুবাস আসবে কোত্থেকে!! ওই ঘ্রাণটা আমার ঠোঁটের খুব কাছাকাছি এসেই হুট করে আবার দূরে চলে গিয়েছিল। রাতভর অনেক খুঁজেছি জলেশ্বরীকে। কিন্তু শুধু জ্বলজ্বলে একটা তারা ছাড়া চোখে আর কিছুই দেখিনি তখন।