আর্কাইভ | এলোমেলো ভাবনা RSS feed for this section

ঠোঁটে তাঁর শিশুমালতির ঘ্রাণ

26 ডিসে.

শৈশবেই হারিয়ে ফেলেছি জলেশ্বরীর সুর, সেই সুর বিহীন আমার সব গানই এখন নিষ্প্রাণ। বহুদিন পর কাল স্বপ্নে দেখেছি- জলেশ্বরী তোমার ঠোঁটে লেগে আছে আজও শিশুমালতির ঘ্রাণ

       (ঠোঁটে তাঁর শিশুমালতির ঘ্রাণ—সুজন সুপান্থ)

শিশুমালতির নাম শুনলেই শৈশবে চকচক করে চোখের সামনে ভেসে উঠতো ছোট্ট একটা মলমের কৌটো। শীতে ঠোঁট ফেটে গেলে ওই শিশুমালতির শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া তখন আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। লাল রংয়ের মলমের মতো দেখতে অনেকটাই। ছোটবেলায় ওই একটা শিশুমালতি কিনে হাফপ্যান্টের পকেটে রেখে পাড়ার সবার সামনে পালোয়ানি দেখাব বলে, কত না চেষ্টা করেছিলাম। এক টাকা দামের ওই শিশুমালতি কিনব বলে কত দিন থেকে যে স্বপ্ন দেখতাম! অবশ্য সেই স্বপ্ন খুব কমই পূরণ হতো আমার। পূরণ হতো না বাবা কিনতে দিতেন না বলেই। কিন্তু আমাদের পাশের বাড়ির বাবলু আর নীলা মাসি যখন শিশুমালতি মেখে ঠোঁট দু’টো চকচক করে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসি দিতো তখন বুকের ভেতরে কেমন গুমরে উঠতো আমার। মনের অজান্তেই চোখের কোণা দিয়ে লেবুর রসের মতো কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়তো।

বুকের ভেতর গুমরে ওঠে শিশুমালতির নাম

শিশুমালতির প্রতি যে শুধু আমারই ঝোঁক ছিল, তা কিন্তু নয়। আমার বড়ভাইয়েরও একই রকম ঝোঁক ছিল। বিশেষত আমি ওটা কিনতে পারতাম না বলে ওর খুব মন খারাপ হতো। এটা আমি ঠিকই বুঝতে পারতাম। একবার রাতের বেলায় আমি আর আমার ভাই হ্যারিকেনের আলোর সামনে বসে ঘোঁট পাকিয়ে সিদ্ধান্তে আসলাম, আমরা আমাদের পুরোনো খাতাগুলো বিক্রি করে দেব। তারপরও ওই টাকা দিয়ে দু’জন দুইটা বড় শিশুমালতির কৌটা কিনব। পরদিন সকালে দুই ভাই মিলে আমাদের পুরোনো খাতা জমা করে দোকানে বিক্রি করে শিশুমালতি কিনে নিয়ে এসেছিলাম। ততদিনে বাবলুর শিশুমালতির কৌটা শেষ হয়ে গেছে। তাই আমরা ঠোঁটে শিশুমালতি মেখে বাবলুর সামনে গিয়ে মুচকি হাসতাম। তখন বাবলু কিংবা নীলা মাসির বুকের ভেতর গুমরে উঠতো কি না জানি না। আমার সেই ভাই এখন আর আমার মাঝে নেই। নীলা মাসি এখন পরের ঘরে। পরম মমতায় নিজের সন্তানদের ঠোঁটে শিশুমালতি বা অন্যকিছু লাগিয়ে দেন কি না জানি না। খোঁজ নেই বাবলুরও। শিশুমালতিও ঠোঁটে দেওয়া হয় না আর বহুকাল।

হারিয়ে ফেলেছি জলেশ্বরীর সুর

আমি জলেশ্বরীকে শিশুমালতির কথা বলিনি কোনোদিন। মানে, ঠিক মনে ছিল না বলেই হয়তো বলা হয়ে ওঠেনি। জলেশ্বরীর ঠোঁটও কিন্তু চকচক করতো। এক ধরনের মিষ্টি সুবাসও পাওয়া যেত মাঝে মাঝে। আঁঁচ করতে পারিনি, তবুও কেন যেন জলেশ্বরীর ঠোঁট থেকে ভেসে আসা ওই সুবাস আমার খুব পরিচিত, খুব আপন বলে মনে হত। মনে করার চেষ্টা করতাম, কিন্তু শেষমেষ তা আর হতো না। বুকের ভেতর কষ্ট হতো। ওই কষ্টের কথা জলেশ্বরী বোধহয় ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি কোনোদিন।

খুব ইচ্ছে হতো জলেশ্বরীর ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে আমার ঠোঁটে ওই সুবাস মেখে নিই। কিন্তু সে সাহস হয়নি কখনো। কল্পনায় অনেকবার সাহস করেছিলাম। কিন্তু সে অধিকার আমার ছিল কি না এই তথ্যটুকুও আমার জানা ছিল না তখন। অথচ সেসময় আমার প্রতিটি কথা গান হয়ে জলেশ্বরীর সুরেই বেজে উঠতো প্রতিনিয়ত।

জলেশ্বরী আমাকে কী ভেবেছিল সে প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু আমি তাঁকে জলেশ্বরীরও অধিক ভেবেছিলাম। হয়তো সেও ভেবেছিল কিংবা ভাবতো না বোধ হয়। তাঁর ভাবনাটা জানতে পারিনি কখনো। চেষ্টা করেছিলাম। হঠাত্ এক মাছরঙা বিকেলে প্রথম জলেশ্বরীর ঠোঁটের খুব কাছে গিয়েছিলাম আমি। সেদিনও জলেশ্বরীর ঠোঁটে শিশুমালতির গন্ধ পেয়েছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে এখনও। তারপর ওই ঠোঁটের কাছে আর যাওয়া হয়নি কখনো। কারণ, সেই মাছরঙা বিকেলেই কোনো কিছু না বলে জলেশ্বরী থামিয়ে দিয়েছিল তাঁর সুর। নির্বাক আমি তাকিয়ে দেখেছি—জলেশ্বরী আলো জ্বলা পাখিদের মতো আলো জ্বেলে জ্বেলে চলে যাচ্ছে দূরে বহুদূরে। যেতে যেতে মিলিয়ে যায় এক সময়। আর চোখের সামনে ভেসে ওঠে সন্ধ্যার বিশাল আকাশে জ্বলজ্বলে একটি তারা।

ঘরজুড়ে শিশুমালতির ঘ্রাণ

বহুদিন পর কাল রাতে জলেশ্বরী এসেছিল। আমার ঘর জুড়ে শিশুমালতির ঘ্রাণ পেয়ে আমি ঠিকই বুঝেছিলাম জলেশ্বরীই এসেছে দূর হতে আমাকে দেখতে। ও হয়তো আগের মতই আছে। সেই চকচকে ঠোঁট, ঠোঁটে শিশুমালতির ঘ্রাণ। তা না হলে আমার ঘরে তাঁর ঠোঁটের ওই সুবাস আসবে কোত্থেকে!! ওই ঘ্রাণটা আমার ঠোঁটের খুব কাছাকাছি এসেই হুট করে আবার দূরে চলে গিয়েছিল। রাতভর অনেক খুঁজেছি জলেশ্বরীকে। কিন্তু শুধু জ্বলজ্বলে একটা তারা ছাড়া চোখে আর কিছুই দেখিনি তখন।

বাবা, তোমার আঙুলে ঝুলে আছে শৈশব

19 জুন

তখনও স্কুলের পড়াশোনা শুরু হয়নি। মানে স্কুলে ভর্তি হওয়াই হয়নি। ঘুমাতাম মায়ের সঙ্গে। হঠাত্ করে একদিন আকাশে বজ্রপাতের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। চিত্কার করে একটা হল্লা বাঁধিয়ে ফেলেছিলাম সেদিন। তারপর সেই রাতে বাবার গা জড়িয়ে ধরে তাঁর বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম পরম নির্ভরতার বিশ্বাসে। সেই যে বাবার বিছানায় ঘুমিয়েছি তারপর নবম শ্রেণী পর্যন্ত নিয়মিতই বাবার সঙ্গে ঘুমাতাম আমি। মাঝে মাঝে মা কতবার যে আবদার করেছিলেন তাঁর সঙ্গে ঘুমানোর জন্য, কিন্তু মায়ের সেই আবদারকে কখনোই গা করা হয়নি আমার। আর বাবাও কেন যেন ছাড়াতেন না আমায়। আমি মোটেও গরম সহ্য করতে পারতাম না। তাই যখন বাবার পাশে শুয়ে থাকতাম, বাবা সব সময় ঘোরানো হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতেন আমাকে। আর আমি বাবার কোলে একদম আটুলি হয়ে গুটুর গুটুর করে আবদারের গল্প বলে যেতাম। বাবা আপন মনেই সেসব আবদার শুনে যেতেন। দিন হলেই পূরণ হতো সেই সব আবদার। তবে একটা বিষয় কী- বাবা যে হাতপাখা ঘুরিয়ে আমাকে বাতাস করতেন, সেটা বাবার এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন তাঁর মাথার ওপর ফ্যান ঘোরে কিন্তু তারপরও ঘুমন্ত অবস্থাতেও সারারাত তিনি একহাতে ঘুরিয়ে যান হাতপাখা। মা মাঝে মাঝে এ কারণে বেশ বকাঝকাও করেন বাবাকে। বাবা নাকি মাকে তখন বলেন, সুপান্থের তো গরম সহ্য হয় না, তাই ওকে বাতাস করছি। এই তো আমার বাবা। অতি সাধারণ এক বাবা। আমি তখনও বেশ ছোটো। বাবা সকালে চা-নাস্তা করেই শেভ করতেন। তারপর ঘর থেকে সাইকেলটা বের করে আমাকে ডাক দিতেন। আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবেন তিনি। তখন সাইকেল জিনিসটাকে ভীষণ ভয় হতো। কিছুতেই সাইকেলে উঠব না। কী আর করা! বাবা তখন হেঁটেই ঘুরতে নিয়ে যেতেন আমাকে। আমি বাবার হাতের আঙুল ধরে ঝুলাতে ঝুলাতে হাঁটতে থাকতাম। আর বাবা তাঁর মনের ভেতর ডুবে থাকা সংসারের নানা কথা অকপটে বলে বলে যেতেন আমাকে। আমার অতটুকুন বয়সে বাবা ওসব কথা বলে কী যে আনন্দ পেতেন তা আজও বুঝতে পারি না আমি। কৃষক যখন আমাদের জমি হাল চাষ করতেন, বাবা তখন আমাকে নিয়ে আইলে বসে বসে দেখতেন। জমি চাষ করা শেষে যখন জমি মই দেওয়ার সময় আসে-বাবা কৃষককে সরিয়ে দিয়ে নিজেই মই দিতেন। বাবা মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে গরু দুটিকে তাড়িয়ে বেড়াতেন। আর আমি মইয়ের ওপর পা দিয়ে বাবার পেছনে তাঁকে জড়িয়ে ধরে থাকতাম। সেই মই সারা জমি ঘুরে ঘুরে আসতো। সঙ্গে আমি ও বাবা। সে যে কী আনন্দ! প্রতি বিকেল বেলা বাবা বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে হাটে যেতেন। হাটের নাম বুড়ির হাট। হাট থেকে ফেরার সময় নকুলদানা, বাতাসা, তিলের খাজা বা পেয়াজু যে কোনো একটা খাবার বাবা লুঙ্গির প্যাচে লুকিয়ে নিয়ে আসতেন। প্রতিদিনই। তারপর আমাকে চুপ করে ঘরে ডেকে সেসব খাবার দিতেন। এই যে, এতো যে বড় হয়েছি তারপরও বাড়িতে গেলে বাবা এখনো লুঙ্গির প্যাচে করে হাট থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে খাবার এনে আমাকে দেন। এ নিয়ে কিছু বললেই এক গাল হেসে দেন তিনি। তাঁর মুখের ওই হাসিতেই সব কিছু ভুলে যাই আমি। ওই হাসিই যেনও পরম প্রশান্তি আমার। কখনোই আমার কোনো আবদার অপূর্ণ রাখেননি বাবা। কত অদ্ভুত আবদার যে তিনি পূরণ করেছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বাবার বালিশের পাশে জর্দার কৌটার মধ্যে টিকিটিকির ডিম রেখে দিতাম আমি। বাচ্চা ফুটবে বলে। এ কারণে মা খুব বকুনি দিতেন। সেই বকুনির হাত থেকে বাঁচাতেন বাবা। এমনকি তিনি আমার ওই টিকটিকির ডিমঅলা জর্দার কৌটা তাঁর বালিশের পাশ থেকে কোনোদিনই ছুঁড়ে ফেলে দেননি। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ে বাবার। বড় হয়ে উঠি আমি। স্কুল কলেজ পেরিয়ে অবস্থান তখন ভার্সিটিতে। অনুভব করি বাবার পাশে না ঘুমানোর অভাব, অনুভব করি অর্থের অভাব। তারও অনেক দিন আগে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি থেকে ইচ্ছাকৃত অবসর নিয়েছেন বাবা। তাই অভাবটা একটু ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম আমি। কিন্তু তাই বলে বাবা কোনো মাসে টাকা দেননি এমনটা হয়নি। দিতেন কিন্তু সেটা বড্ড অসময়ে। একবার সন্দেহ হয় মনে, বাবা কীভাবে আমাকে প্রতিমাসে টাকা পাঠান। এভাবেই শেষ হয় ভার্সিটি জীবন। একদিন জানতে পারি, বাবা কাউকে না জানিয়ে জমি বিক্রি করে টাকা পাঠাতেন আমার কাছে। এ কথা শুনে শুধুই নির্বাক হয়ে ছিলাম আমি। এই তো এরকমই সরল আমার বাবা। যার মুখে কোনোদিন বিরক্তির রেখা দেখিনি, সর্বংসহা সে আমার ঈশ্বর। এখন অবশ্য আমিই বাবার সব ইচ্ছে, আবদার পূরণ করে দিই। তিনি কিছুই বলেন না আমাকে। তবে আমি বুঝি বাবার ইচ্ছে কী এবং কেমন। সেভাবেই চেষ্টা করে যাই আমি। শুধু তাঁর মুখের ওই হাসিটা দেখতে। এখন প্রতি সন্ধে বেলায় ফোনে বাবার সঙ্গে আধা ঘণ্টাখানেক কথা বলি। শুরুতেই বাবা জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাত খেয়েছিস?’ আমি ভাত খেলেই যেনও সুখ পান তিনি। তারপর জিজ্ঞেস করেন, কবে আসবি তুই? ছুটি দেবে অফিস থেকে? আমার তো কিছু না, তোর মার নাকি তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে! সময় করে আসিস কিন্তু—এ কথা বলতে বলতেই গলা ধরে আসে বাবার। জবাব দিতে পারি না কোনো। বাবা ইচ্ছে করেই ফোন কেটে দেন। মনের পর্দায় বাবার আঙুল ছাড়া আর কিছুই ভেসে ওঠে না। সে সময় আমি অন্ধ হয়ে যাই অনেকক্ষণ ধরে।

ও মা, তোমার আঁচলে বাইন্ধা রাখছি প্রাণ

8 মে

তখন নবম কি দশম শ্রেণীতে পড়ি। সে সময় হঠাত্ করেই তীব্র মঙ্গা গ্রাস করেছিল আমাদের। চাল নেই, তাই চুলা জ্বলত না বেশ কয়েক দিন। তারপর কোনোভাবে যদি একবেলার চাল জোগাড় করতেন মা, তখনই জ্বলে উঠত চুলা। ওই সময়ের বেশির ভাগ দিনই আমাদের কেটেছে শুধু সেদ্ধ আলু খেয়ে। আলু সেদ্ধ হওয়ার পর আমরা সবাই গোল হয়ে বসে পড়তাম চুলার কাছেই। মা তখন কারও সঙ্গেই কোনো কথা বলতেন না। এমনকি তাকাতেন না কারও দিকে। অন্যদিকে তাকিয়ে সবার প্লেটে আলু তুলে দিতেন। কোনো শব্দ ছাড়াই যে যার মতো খেয়ে নিজেদের কাজে চলে যেত সবাই। আমি ছিলাম সবার ছোট। মায়ের কোল ঘেঁষে থাকাটাই ছিল আমার স্বভাব। তাই বুঝতে পারতাম আমাদের সবার পাতে খাবার তুলে দিয়ে মায়ের জন্য অবশিষ্ট আর কিছুই থাকত না। এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগও ছিল না তাঁর। লুকিয়ে লুকিয়ে খুব কাঁদতেন মা।  এত কষ্ট, এত অভাব, মঙ্গা—তার পরও কোনো দিন মাকে ভেঙে পড়তে দেখিনি। দেখিনি তাঁর মুখের হাসিটি কখনো মলিন হতে।

ধীরে ধীরে মঙ্গার আঁধার কেটে ভোর আসে আমাদের জীবনে। সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাই আমিও।

স্কুলের গণ্ডি ছেড়ে যখন আমার কলেজে যাওয়ার সময় হলো, তখন কেউই চাইল না আমি কোনো ভালো কলেজে পড়ি। গ্রামের চালাহীন একটি কলেজে আমাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল সবাই। কিন্তু আমি ছিলাম নাছোড়বান্দা। এ কারণেই মা আমাকে ‘মিনমিনে শয়তান’ বলে ডাকতেন। এখন এত যে বড় হয়েছি, তার পরও ওই নাম ধরেই ডাকেন। শহরের কলেজে ভর্তি হওয়ার পক্ষে দাঁড়ালেন বাবা। ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষায় মেধাতালিকায় প্রথম হলাম। কিন্তু বিশ্বাস করল না কেউই। করল না অবশ্য টাকা খরচের ভয়েই। আস্তে-ধীরে পেরিয়ে যেতে লাগল ভর্তির তারিখ। বাবার হাত খালি। কোনোভাবেই কেউ টাকা দিতে রাজি হলো না। ভর্তির একদম শেষ দিনে এসে জুড়ে দিলাম কান্নাকাটি। শেষ মুহূর্তে নিজের গলা থেকে সোনার হারটা খুলে দিলেন। সেই হার বিক্রি করেই সেদিন ভর্তি হয়েছিলাম কলেজে।

মা যে পড়ালেখা জানতেন না, তা নয়। তার পরও প্রতিটি বিকেলে আমাদের জাম্বুরাগাছের নিচে টংয়ের ওপর বসে মাকে পত্রিকা পড়ে শোনাতে হতো। পত্রিকা পড়া শেষ হলে মা জুড়ে দিতেন রাজ্যের গল্প। মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে সেসব গল্প শুনতে শুনতে হারিয়ে যেতাম আমি। বিকেলে রোদ চুয়ে যখন নেমে আসত সন্ধ্যা, উঠোনের মাঝে হারিকেন জ্বালিয়ে শুরু হতো আমাদের ছয় ভাইয়ের পড়াশোনার পালা। সামনে শিক্ষক হয়ে বসে থাকতেন মা।

মায়ের চেহারাটা ইদানীং মলিন হয়ে গেছে। তার পরও সেই পরিশ্রান্ত চেহারার মাঝে যে পরম প্রশান্তি ও নির্ভরতার ছায়া দেখতে পাই, তাতে ভর করে আমরা পথ চলার সাহস পাই, হাজার বছরের পথ…।

বুনোহাস মন

4 জানু.

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক দূরবর্তী বন্ধু ছিলো। বন্ধু মানে ঠিক বন্ধু নয়। একই ব্যাচের পরিচিত এক জন। তবে কিছুটা সখ্যতা ছিলো তাঁর সঙ্গে।
গতকাল রাতে হঠাত করেই তাঁর সঙ্গে দেখা। তাই কিছু কথা মনে পড়ে গেলো।
বন্ধুটির নাম ছিলো হুযায়ফা নূর। একদম সাধাসিদে ছেলে। তাঁর নাম শুনে কেউ বিশ্বাস করতে পারতো না যে এটি কোনো ছেলের নাম হতে পারে। ঠিক তেমনি বিশ্বাস করতে পারে নি খোদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও। যখন ও বিশ্ববিদ্যলয়ে ভর্তির জন্য ফরম জমা দেয়। তখনই ঘটলো মজার ঘটনাটা। বিশ্ববিদ্যালয় বেচারা হুযায়ফার ফরম দেখে মেয়ে ভেবে তাঁর জন্য মেয়েদের হল ‘মুন্নুজান হলে’ সীট বরাদ্দ করেছেন। বেচারা হুযায়ফা না বুঝেই বিছানাপত্র নিয়ে মুন্নুজান হলের সামনে গিয়ে হাজির। কেউই তো তাকে ঢুকতে দেবে না। কিন্তু হুযায়ফাও নাছোরবান্দা। অবশেষে আবাসিক ছাত্রী, হল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এক রা হয়ে যাওয়ার পর প্রশাসন এসে নিজেদের ভুল স্বীকার করে হুযায়ফাকে বুঝিয়ে নিয়ে যায়। এই হলো কাহিনী।
হুযায়ফা তো ছাত্রী হল থেকে ফিরে এসেছে। তবে আমার কিন্তু এক রাত ছাত্রী হলে কাটাবার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই ঘটনা বাইরের কেউই জানতো না। সে কথায় পরে আসি।
আমি যখন ছোট তখন বাবা বেশ কিছু বিদেশী ফুলের গাছ নিয়ে এসেছিলেন বাসায়। বাবা খুবই বাগান বিলাসী। এখনও তাই আছেন। আমাদের বাগানে সেই ফুলের মধু খেতে রং বেরংয়ের প্রজাপতি আসতো। আমি সারা দিন সেই প্রজাপতির পিছু পিছু ছুটে বেড়াতাম। দিনমান সে সব প্রজাপতি নানা রংয়ে মাতিয়ে রাখতো আমাদের বাড়ি। এ ঘর ও ঘর বারবার তারা ঢু মেরে যেতো। বাবাকে তারা খুব পছন্দ করতো বোধ হয়। যখন প্রজাপতি গুলো এ ঘর ও ঘর করে বেড়াতো তখন সংসারে নাক অব্দি ডুবে থাকা আমাদের মা ও কেমন খুশি হয়ে উঠতেন।
প্রায়ই আমি বাবার ঘরের জানালা ধরে বসে থাকতাম। বাগানটা ছিলো বাবার জানালার পাশেই। এখনো আছে। আমি জানালার শার্সি দিয়ে যখনই কোনো নতুন প্রজাপতিকে দেখতাম তখনি প্রজাপতির মতোন কিংবা বুনোহাসের মতো তাদের পিছনে দিতাম এক ছুট। গাছ গুলোর পায়ের কাছে পোষ মানা আদুরে হাতির মতো কান নাড়তো অঢেল ছায়া। আর সেই ছায়াই পরম মায়া নিয়ে উল্লাস করতো প্রজাপতিরা।
আমার একটা বদ স্বভাব ছিলো। প্রজাপতির পিছনে ছুটে তাদের খপ করে ধরে ফেলতাম। তারপর চুরি করে তাদের ধরে একটা ডায়েরীর পাতার মধ্যে চাপা দিয়ে রাখতাম। এভাবে অনেক প্রজাপতি জমিয়েছিলাম আমি। আমি কী এক ভেল্কিও জানতাম। সহজেই প্রজাপতি গুলো ধরা দিতো আমার হাতে। মা কে একদম জানতে দিতাম না। কিন্তু কী করে যেনো মা তা জেনেও গিয়েছিলো। তারপর থেকে মা আমাকে মিনমিনে চাঁদ মুখো শয়তান বলে বকা দিতো। এখন আর এই কথাটা মা বলেন না। হয়তো ভুলে গেছেন। ভুলে যাওয়াতো মনে রাখার মতোই স্বাভাবিক ধর্ম।
এক সময় দেখতাম চাপা রাখা প্রজাপতি গুলো পেঁচ যেতো। তারপর থেকে প্রজাপতিদের আর ধরিনি। যদিও তা অনেক পরের ঘটনা। এখনও সেই বাগান আছে, আছে সেই ফুলের গাছ গুলো সঙ্গে হরেক রংয়ের প্রজাপতি। এখনো তারা পসরা সাজিয়ে বসে আমাদের বাড়িতে। শুধু আমারই আর তাদের মাঝে থাকা হয় না। এখনও বাসায় গেলে সেই গাছ গুলোর গরিব চেহারার মাঝখানে আমি আমার মা আর বাবা’র সুছাঁদ স্নিগ্ধ মুখের সেই পরম নির্ভরযোগ্য আলো দেখতে পাই।
সে যা হোক। এক সময় বাবা আমার এই প্রজাপতির পেছনে ছুটতে দেখে খুব বিরক্ত হতেন। তাই পরিকল্পনা করে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দিলেন শহরের একটি স্কুলে। স্কুলটি মেডেকেল কলেজের ভিতরে ছিলো। এখনো তাই আছে। আমার মেজ ভাইয়ের দায়িত্ব ছিলো প্রতিদিন মোটর সাইকেলে করে আমাকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া এবং ছুটির পর বাসায় নিয়ে আসা। তো আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া আসা করতে করতেই তিনি এক রুপসী মেয়ের প্রেমে পড়ে যান। সেই মেয়েটি স্কুল বিল্ডিংয়ের ঠিক পাশের বিল্ডিংয়েই থাকতেন। ওটা ছিলো শিক্ষানবীশ নার্সদের থাকার হোস্টেল। তাঁদের এই প্রেমের কারণে আমার স্কুল ছুটির পর মেজ ভাই প্রায়ই দেরি করে আসতো। মাঝে মাঝে অনেক দেরি করে আসতো। তখন আমি একাই দীর্ঘ পথ হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরতাম। ফিরেই কান্না কাটি জুড়ে দিতাম। তারপর মেজ ভাই আমাকে খুঁজে না পেয়ে পাগলের মতো বাসায় আসতো। তখন মা তাঁকে খুব বকুনী দিতো। পরে অবশ্য সেই মেয়েটির সঙ্গেই বাবা তাঁর বিয়ে দিয়েছেন।
বিয়ের পরও ভাবী হোস্টেলেই থাকতেন। তখনো পড়াশোনা শেষ হয় নি। আমি টিফিন পিরিয়ডে ভাবীর রুমে যেতাম। তখন বেশ ছোট ছিলাম। সেখানে কিছু খেয়ে আবারও স্কুলে আসতাম। ভাবীর হোস্টেলের সবাই আমাকে চিনতো।
যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। তখন দেখতে আমি বেশ বড় সড় ছিলাম। তাই ভাবীর হোস্টেলে প্রবেশে এবার বাঁধা এলো। যেতামও না আর। সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষার সময় প্রচন্ড বৃষ্টি। তার ওপর আবার অনেক দুর থেকে স্কুলে যেতে হতো। তাই ভাবী এক পরীক্ষার আগের দিন আমাকে তাঁর হোস্টলে নিয়ে গেলেন। সন্ধ্যে বেলায় বাইরে ঘাপটি মেরে ছিলাম অনেক্ষণ। বাইরে যখন কেউ ছিলো না ঠিক সেই মুহুর্তে চুপ করে আমরা ঢুকে পড়ি হোস্টেলের ভেতরে। ভাবীরা চার জন থাকতেন। সবাই আমাকে চিনতো। আমাকে দেখে তারা যার পর নাই খুশি। কিন্তু ঝামেলাটা হলো রাতে। রাতে একবার চেক করার জন্য ম্যাট্রন আসেন প্রতিটি রুম দেখতে। ভাবীর রুমের দরজায় কড়া নাড়তেই ভাবীরা তটস্থ হয়ে পড়েন। তরিঘরি করে আলমারী খুলে আমাকে আলমারীর মধ্যে ঢুকিয়ে দরজাটা এমনি লাগিয়ে দিলেন। আমি বুঝতে পারি নি বিষয়টা। কিন্তু ম্যাট্রন এসে ভাবীদের সঙ্গে খোশ গল্পে মেতেছেন। তাঁর যাওয়ার কোনো নাম গন্ধ নেই। এদিকে আমি ঘেমে একদম চাবচুব। ভয়েও বুকটা গুবগুব করতে থাকলো। প্রায় ২০ মিনিট পর ম্যাট্রন চলে যাওয়ার পর আমাকে বের করা হলো। তারপর কোনো রকমে রাতটা পার করেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এই হলো আমার ছাত্রী হোস্টেলে রাত কাটাবার অভিজ্ঞতা।
সময় কেটে গেছে অনেক। এখনও বুনো হাস মন মাঝে মাঝে চাগান দিয়ে ওঠে। মনে ছুটে যাই আগু মুখো নদীর কাছে, বা সেই প্রজাপতিময় আমাদের বাগান বাড়িতে কিংবা এ শহর ছেড়ে দুরে বহুদুরে….।

প্রকৃতির মতোন বেড়ে ওঠা

27 ডিসে.

ছেলেবেলায় প্রায় প্রকৃতির মতোই বেড়ে উঠেছি আমি। সব কিছু এখন আর স্পষ্ট মনে পড়েনা। তারপরও কিছু কিছু স্মৃতি মনের খিড়কী দুয়ারে বারবার উঁকি ঝুঁকি মারে। সে গুলো আমাকে বড্ড তাড়না দেয়।
ছেলেবেলায় আমি একটু জেদী ছিলাম। ছিলাম হয়তো কোনো কিছু ভালো লাগতো না বলে। তখন আমি প্রায় খালি পায়ে হাঁটতাম। পায়ের তলায় খেজুরের কাটা বিঁধেছে তা কখনো পাত্তাই দেই নি। এজন্য মায়ের কত্ত বকুনী খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।
ছোটবেলায় একদমই স্কুলে যেতে মন চাইতো না। তারপরও বাধ্য হয়েই যেতে হতো প্রতিদিনই। স্কুলের গেটে যেতেই ভয়ে বুকের ভেতর কেমন গুবগুব করে উঠতো। আমাদের বাড়ির পাশেই কয়েকটা ঘর হিন্দুদের ছিলো। এখনো আছে। তবে সেই ঘর গুলোর আয়তন এখন অনেক বেড়ে গেছে। সেই হিন্দু ঘরের আমার চেয়ে এক বছরের বড় একটি মেয়ে ছিলো। তাঁকে নীলা মাসী বলে ডাকতাম, এখনও ডাকি। নীলা মাসী প্রতিদিনই আমাকে স্কুলে নিয়ে যেত। আমি রোজ সকাল সকাল বাবার বুড়ির হাট থেকে কিনে দেওয়া হাফ প্যান্ট আর বড় ভাইয়ের কিনে দেওয়া পকেট বিহীন ছোট্ট পাঞ্জাবী পড়ে নীলা মাসীর জন্য বসে থাকতাম। নীলা মাসী আমাদের বাসায় এলে বই গুলো রুমাল দিয়ে বেঁধে বগলদাবা করে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যেতাম। স্কুলে যাওয়ার পথেই পড়তো ইয়া বড় এক তেঁতুল গাছ। এখনও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে সেই তেঁতুল গাছটি। একবার কবি কমল মমিন আমাকে এক চিঠিতে এমনিই লিখেছিলেন, ‘সুপান্থ, তোমাদের বুড়িরহাটে যুবতীরা থাকে। তাঁরা তেঁতুল গাছের তলে নাচে, কথা কয়।’ আজ অনেক দিন পর বুঝতে পারি কবি কেন এ কথা লিখেছিলেন। সত্যিই এখন সেখানে অনেক যুবক যুবতী ভিড় জমায়। নিশি রাতে কথা কয়। ডাক দেয় নিশুতি রাতের নির্জনে। অনেকেই সে ডাকে সাড়া দিয়ে যায়। থাক এসব কথা।
সেই তেঁতুল গাছটিতে থোকায় থোকায় তেঁতুল ঝুলে থাকতো। নীলা মাসী আমার জন্য অন্যদের কাছে চেয়ে চিন্তে তেঁতুল নিয়ে আসতো। তারপর সেই তেঁতুল খেতে স্কুল। রোজ স্কুলের পেছনের বেঞ্চে বসা হতো। বসা হতো এই কারণে যে, তখন শিক্ষকদের খুবই ভয় লাগতো। তবে পরীক্ষায় কিন্তু সব সময় প্রথমেই থাকতাম আমি।
বাবা প্রতিদিন সকালে স্কুলের টিফিনের জন্য এক টাকা করে দিতেন। টিফিন হলেই এক দৌড়ে ধুরধুরে শরীরের হরিহরণের আচারের দোকানে যাওয়া চাই-ই চাই। সেই এক টাকা থেকে পঞ্চাশ পয়সার চালতার আচার আর পঞ্চাশ পয়সার পাপড় কিনে খেতাম। কখনো কখনো হাতি ঘোড়া কিনে খেতাম। সে সময় এক টাকায় বাতাসার হাতি ঘোড়া পাওয়া যেত। একটা খেতাম আর একটা ফুয়াদ ভাইয়ের জন্য নিয়ে আসতাম। ফুয়াদ ভাই ও আমার জন্য তাঁর টিফিনের অনেক কিছু এনে দিতো। ফুয়াদ ভাইয়েরা সে সময় পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল পড়ে স্কুলে যেতো। ওরা যখন চামড়ার স্যান্ডেল পড়তো তখন আমি তাঁদের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ও স্কুল থেকে ফিরলে আমি চুপিচুপি স্যান্ডেল গুলো পায়ে দিয়ে দেখতাম যে, আমায় কেমন লাগে। কারণ, আমার চামড়ার স্যান্ডেল ছিলো। ছোট বলে বাবা আমাকে তা কিনে দিতো না। আমি যখন চামড়ার স্যান্ডেল পড়েছি তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। আজও খুব মনে পড়ে ছোটবেলায় ফুয়াদ ভাই বুড়ো আঙ্গুল চোষার অভ্যাস ছিলো। আঙ্গুলের সেই নোনতা স্বাদ সে কেনো এতো গ্রহণ করতো তা আজো আবিস্কার করতে পারিনি। এখনও যদি দুই ভাই একত্রে হই আমি তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করি। কিন্তু ও বেমালুম তা অস্বীকার করে যায়। আর ও এই সত্যি কথাটা অস্বীকার করলে আমার কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে।
আম আাঁাটির ভেঁপু বাজাতে বাজাতে বাসায় ফিরতাম। তারপর স্কুল থেকে ফিরেই ছুটে যেতাম পুকুর পাড়ে। পুকুরের সেই শান ঘাটে কত সময় যে কেটেছে আমার! একটা ইয়া বড় ধেড়ে মাছ ছিলো সেই পুকুরে। মাঝে মাঝে দু’চারটে ঘাই তুলে ভেসে উঠতো মাছটি। আর ছোট ছোট মাছগুলো পানিতে বুড়বুড়ি তুলতো। দেখতে যে কি মজা লাগতো। প্যান্টের পকেটে এক পকেট মুড়ি আর এক টুকরো খেজুরের গুড় নিয়ে বসতাম পুকুর ঘাটে। খেতাম আর মাছেদের উত্সব দেখতাম। মাঝে মাঝে হুশহাস করে কানের পাশ দিয়ে উড়ে যেতো কুঁচকুচে কালো ফিঙ্গে আর ধবল সাদা বক। পড়ন্ত দুপুরে বাসায় ফিরতাম।
বিকেল বেলাটা ছিলো খেলার সময়। কিন্তু কখনো মাঠে গিয়ে কারো সঙ্গে খেলা হয়নি কোনোদিন। বিকেলে দেখতাম বাবা আমার বড় ভাইদের নিয়ে বাইরের বড় উঠোনটাতে ব্যাডমিন্টন বা ক্যারাম খেলতো। আমাকে তাঁরা নিতো না। তাছাড়া সে সময় তো খেলতে পারতাম না। তাই পুরো বিকেলটাই ফরিঙ ধরে বেড়াতাম। বিভিন্ন রং আর বিভিন্ন জাতের ফড়িঙ ধরে বেড়াতাম আমি। কখনো কখনো দুইটা ফড়িঙকে বড় পাতা দিয়ে ঢেকে রাখতাম। কিছুক্ষণ পর দেখতাম একটি ফড়িঙ ডিম দিয়েছে। এতেই খুব মজা পেতাম তখন।
আমাদের একটা বড় শিমুল গাছ ছিলো। বাতাসে শিমুল তুলা ভেসে বেড়াতো। সেই শিমুল তুলা ধরার জন্য কত যে ছুটোছুটি করেছি বাতাসের সঙ্গে। পাজি বাতাস একবার ধরা দিলে দশবারই পালিয়ে যেতো।
এভাবেই আস্তে ধীরে বিকেলটা ক্লান্ত হয়ে আসে। সঙ্গে আমিও। তারপর ঘটা করে হাত মুখ ধোয়ার পালা। এরপর আমাদের জাম্বুরা গাছের তলে টংয়ের ওপর বসে মায়ের কাছ থেকে গল্প শুনতে বসতাম। মা বসে বসে রাজ্যির কথার ভুশড়ি ভাঙ্গতো। আর আমি মায়ের কোলে একদম আঁটুলি হয়ে থাকতাম। মনের রাশ আলগা করে দিতেন মা। সন্ধ্যার পরে মা রান্না বান্নার কাজ করতেন। এখনো করেন। আমার বোধ হওয়া থেকে তাই দেখছি। আমার মনে হয় এতোদিনে রান্না ঘরের হাঁড়ি পাতিল থেকে শুরু করে সবকিছুই হয়তো তাঁকে ‘মা’ বলে ডাকতে শিখেছে। মা হয়তো সেই ডাকে সাড়াও দিয়ে যান।
একটু রাত হলে বাড়ির আঙ্গিনায় পাটি বিছিয়ে হারিকেনের আলোতে সবাই এক সঙ্গে পড়তে বসতাম। বিভিন্ন ছুঁতোয় আমি ওই পড়ার আসর থেকে পালিয়ে যেতাম। খুঁজে বেড়াতাম টিকিটিকির ডিম। আমাদের টেবিলের ওপর প্রতি রাতেই টিকটিকির ডিম পাওয়া যেতো। সেই ডিম আমি একটি কৌটার ভেতর লুকিয়ে রাখতাম। ফুটে বাচ্চা বের হবে বলে। কিন্তু সেই বাচ্চা কোনো দিনই ফুটতো না। এজন্য অনেকদিন বকুনী খেয়েছি আমি।
রাত একটু গাঢ় হলে বাবা সবাইকে নিয়ে খেতে বসতেন। আমাদের একটি কুকুর ছিলো। বাহাদুর নামে ডাকতাম। সেই বাহাদুর এখন আর নেই। তবে আজও একটি বাহাদুর আমাদের বাসায় থাকে। বাবা বাহাদুরকে খুব পছন্দ করতেন। তাই আমরা খাওয়ার সময় বাহাদুরও পাশে বসে থাকতো।
সব সময় বাবার সঙ্গেই ঘুমাতাম। বাবার মুখে গল্প শুনতে শুনতে কখন যে আস্ত একটি রাত মোমের মতো গলে পড়তো তা টেরই পেতাম না।
আজও স্মৃতি হাতরে সে সব দিনগুলোকে খুঁজে ফিরি। আজও দেখার চেষ্টা করি, ছোটবেলায় দেখা মিনতী মামীর বুকের মতো নিস্তব্ধ গোল আকাশ।

ডুমুর গাছের ভুত

21 ডিসে.

আমরা তিনজনই ডুমুর গাছে ভুত দেখতাম। তবে কখনো কখনো দুই জন দেখতাম। গা কেমন শিঁউরে উঠতো।
চারিদিকে ক্ষেত আর ক্ষেত। ওদিকে কোনো বাড়ি ঘর নেই। বিশাল প্রান্তরে একদম একা দাঁড়িয়ে থাকতো একটা ধেঁড়ে ডুমুরের গাছ। অনেকেই বলতো গাছটা না কি তিনি তাঁর জন্ম থেকেই দেখছেন। আমিও কিন্তু তাই দেখেছি। এখন অবশ্য কেউ দেখতে চাইলে আর দেখতে পারবে না। হতে পারে আমি বা আমরা তিনজন নেই এ কারণে। বা হতে পারে সেই ধেঁড়ে ডুমুর গাছের ভুতটা তাঁর দেশে চলে গেছে তাই গাছটিও আর নেই। আচ্ছা এ কথা পরে বলছি।
ধানক্ষেতের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ডুমুর গাছটি কিছুদুর পেরুলেই বড় ধরণের একটা বিল পাওয়া যেত। বিলটির নাম ছিলো কাঁইয়ার বিল। এখনো আছে। সেখানে প্রতিদিন চা পাখি, হট্টিটি, গোদরঘোষ, পারল, সাদা লাল বক খেলা করে বেড়াতো। আমরা প্রায়ই মায়ের আদেশ অমান্য করে তিনজনই গলা ধরে সেই সব পাখিদের খেলা দেখতে যেতাম। কখনো কখনো বিলের হাঁটু জলে নেমে পদ্ম ফুলের ঢ্যাপ (বীজ) তুলে তিন জনে ভাগ করে খেতাম। কী যে মজা হতো!
মাঝে মাঝে আবার সেই কাঁইয়ার বিলেই বাবার সঙ্গে পাখি মারতে যেতাম। বাবা এয়ারগান দিয়ে খুব পাখি শিকার করতেন। আর আমরা কাঁদা জলে দৌড় দিয়ে বাবার শিকার করা পাখি গুলে তুলে আনতাম। তবে এখন আর পাখি শিকার করা হয় না। এয়ারগানটা এখনো আছে। বাবাও সুস্থ্য আছেন। কিন্তু সেই এয়ারগান আর বাইরে বের করা হয় না। হয় না হয়তো সেই ডুমুর গাছটি নেই বলে। কিংবা সেই ভুতের দেশে ভুত চলে গেছে বলে। কিংবা আমি নেই তাই। অথবা আমাদের একদম কালো কুচকুচে ছাগলটি নেই বলেও হতে পারে।
হ্যা, আমাদের একটা ছাগল ছিলো। আর আমরা সাত ভাইয়ের মধ্যে একদম শেষের পিঠাপিঠি তিন ভাই সেই ছাগলটির দেখাশোনা করতাম। রাখাল জীবন। খুবই ভালো লাগতো সে সময়টা।
আমি, ফুয়াদ ভাই আর মুন ভাই তিনজনে হাতে নকুল দানার প্যাকেট নিয়ে বিকেলে বেড়িয়ে পড়তাম ছাগল খুঁজতে। নকুল দানা চিবোতে চিবোতে আর আজগুবি গল্পের ঝুড়ি খুলে ক্ষেতের আইলে আইলে হাঁটতাম। সকালে ছাগলটিকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসতাম।
ছাগলটিকে কখনো পেতে দেরি হলে আমাদের খুব মন খারাপ হতো। আর তারাতারি পেয়ে গেলে আমরা তিন জনই সেই ডুমুর গাছের নিচে গিয়ে বসতাম। বিভিন্ন ধরণের কথা বলতাম। কত স্বপ্ন, কত কথা কতটা দু:খ ছিলো তখন মনে। অনেক দিনের কথা। তা আজ আর খুব একটা স্বচ্ছ ভাবে মনে পড়েনা।
মুন ভাই ছিলো গাছের পোকা। কোন গাছে পাখি বাসা বেধেছে, কোন পাখির বাসায় কতটি ডিম, কতটি বাচ্চা তা একদম ঠোটের আগায় থাকতো তাঁর। আমাদেরকে তা পেরে পেরে দেখাতো। তাই আমরা যখনই ডুমুর গাছের তলায় যেতাম তখনই সে পইপই করে গাছের মগডালে উঠে যেত। ওই গাছটাতে লাল টকটকে এক ধরণের ফল ধরতো। সে নিজে খেতো আর টুপ টুপ করে একটা করে ফল আমাদের জন্য নিচে ছুঁড়ে দিতো। আমরাও মজা করে খেতাম। তবে শর্ত ছিলো যে, এই কথা মাকে কখনোই বলা যাবে না। আমরা কখনো তা বলতামও না।
একটা সময় হুট করে মুন ভাই গাছের মধ্যে হাওয়া হয়ে যেত। কেমন একটা শব্দ করতো। ভুতের মতোন। ভয় পেতাম খুব। কান্নাকাটি করলে তারপর নেমে আসতো। তারপর আমাকে কোলে তুলে নিয়ে আবারও আইল ধরে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করতো। আমি সবার ছোট ছিলাম বলে সবাই আমাকে আদর করতো। এখনো করে তবে মুন ভাই ছাড়া।
তখন আমি টু য়ে পড়ি। সকাল বেলায় আমার জুতার ফিতা বেধে দিতো মুন ভাই। তারপর মেজ ভাই স্কুলে পৌঁছে দিতো। এভাবেই কেটে গেলো দুই দুইটা বছর। রাখাল জীবনের জন্য মাঝে মাঝে সবার ওপর রাগ হতো। কিন্তু এক ধরণের মজাও পেতাম আমরা।
এক সময় আমাদের ছাগলটিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষমেষ হারিয়ে গিয়েছিলো আমাদের সেই কালো কুচকুচে ছাগলটি। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন আমরা। বিশেষ করে মুন ভাই।
সেই থেকে ওই কাঁইয়ার বিল আর ডুমুর গাছের নিচে যাওয়া আমাদের বন্ধ হয়ে গেলো। বন্ধ হয়ে গেলো পদ্ম ফুলের ঢ্যাপ খাওয়া। তারপরও মন মানতো না। পুরো বিকেলটাই অবসর ছিলো। ও বলাইতো হয়নি। আমরা গ্রামের কারো সঙ্গে খেলতে যেতাম না। তবে খেলা দেখতাম। তাই মাঝে মাঝে ডুমুর গাছের নিচে ঢুঁ মেরে আসতাম আমরা তিন ভাই।
একদিন গিয়ে দেখলাম সেই ডুমুর গাছটি আর নেই। আমরা অনেক খোঁজাখুজি করলাম। কিন্তু নাহ্, কোথাও গাছটিকে পেলাম না। মুন ভাই আর ভুতের ভয় দেখাতে পারবেনা ভেবে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম সেদিন। কিন্তু কেন যেন মুন ভাইয়ের মনটা বেশ ভারী হয়েছিল গাছটিকে না পেয়ে। তারপর ব্যর্থ মনে বাসায় ফিরে পড়তে বসলাম।
এরপর থেকে আর আর ওই ডুমুর গাছের রাস্তায় কখনোই যাওয়া হয়নি আমার, আমাদের। তখন থেকে বিকেল বেলায় হাত মুখ ধুয়ে আমাদের বাসার জাম্বুরা গাছের তলে টঙয়ের ওপর বসে মায়ের কাছে মন দিয়ে বাবার গল্প শুনতাম। বারবার রোমাঞ্চিত হতাম আমরা। মা কখনো বিরক্ত হতেন না। কিন্তু একদিন বাবা অফিস থেকে ফিরে বলা নেই কওয়া নেই মুন ভাইকে খুব করে মারতে শুরু করলেন। এর আগে বাবা কোনো দিন কারো গায়ে হাত তোলেন নি। মুন ভাই পাগলের মতো কান্নাকাটি শুরু করলো। সাথে আমিও ফুয়াদ ভাই। বাবার অভিযোগ ছিলো মুন ভাই টাকা চুরি করেছে। থাক সেসব কথা।
তার কিছুদিন পর এক ঝড়ে আমাদের সুপারী বাগানের সবচেয়ে বড় সুপারী গাছটার মাতা ভেঙ্গে যায়। পরের দিন মুন ভাই ওই গাছে ওঠর জন্য জেদ ধরে বসলো। মা কিছুতেই না। কারণ সেদিন আমরা কেউই বাসায় ছিলাম না। তারপরও মুন ভাই গো ধরে গাছে ওঠেই ছেড়েছে। গাছে উঠে মাকে ডেকেছিলো সেদিন। মা ভয় পেয়ে গাছের নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু একটু পরেই কে যেন সেই গাছ থেকে মুন ভাইকে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছিলো। হয়তো সেই ডুমুর গাছের ভুতটা। শুইয়ে দিয়েছিলো এ জন্য বললাম যে, মুন ভাইয়ের গায়ে কোনো ধুলাবালি ছিলো না। তারপর মুন ভাই আর কোনো দিন কথা বলে নি। তাঁর সেই হাসিটিও আমি আর দেখিনি। খুব একটা কল্পনায়ও আসেনা সেই হাসিটা। আমাদের ছেড়ে আজকের এই দিনে সে চলে গেছে অন্য কোনো দেশে। অন্য কোনো সুখের রাখাল জীবনে।
আজকের দিন এলে আমার মা পাগলের মতো হয়ে যান। আমরা তাঁকে বোঝাতে পারি না। আমরাও বুঝিনা।
তারপর অনেকটা বছর পেরিয়ে গেলো। আজ মনে পড়ছে সেই ডুমুর গাছের ভুত, ছাগল আর কাঁইয়ার বিলের পাখিদের কথা।
ভাইয়া তুমি ভালো থেকো। আমাদেরও মনে রেখো…………

সর্বংসহা মা

8 মে

যাঁর মুখে কোনো দিন বিরক্তির রেখা দেখিনি, শত বাঁধায় ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি, সর্বংসহা তিনি আমার মা। হ্যাঁ, আমি আমার মায়ের কথাই বলছি।
অনেকদিন মায়ের মুখ খানি দেখা হয়না। এই ব্যস্ত নগরীর কাজের ভীড়ে মায়ের কাছে যেতে না পারলেও সেই মায়াময় মুখের ছবিটি কাজের ফাকেও দেখতে কখনো ভুল হয়না।
তখন আমি ক্লাস থ্রি কি ফোরে পড়ি। ছোট বেলায় আত্মীয় স্বজনের দেওয়া টাকা পয়সা গুলো সব সময় মায়ের হাতে তুলে দিতাম। তবে একটা শর্তে। আমি চাওয়া মাত্রই যেন আমাকে টাকা গুলো দেওয়া হয়। কোনো কারণে আমি রেগে গেলে কিংবা মা বকুনী দিলে সঙ্গে সঙ্গেই আমার সেই টাকা ফেরত চাইতাম। কিন্তু মা নানা রকম টালবাহানা করতেন সেই টাকা নিয়ে। একদিন টাকা চেয়ে না পাওয়ায় রাগ করে বাসা থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি। আজও সেই ঘটনা মনে পড়লে রোমাঞ্চিত হই। পালিয়েছিলাম কিন্তু পাশেই। যাতে বাসার লোকজনদের আমি দুর থেকেও পর্যবেক্ষণ করতে পারি। বাসার পাশেই আমাদের পুকুর পাড়ে রাত পর্যন্ত বসে ছিলাম। সারাদিন আমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেলো। পরে দেখি আমার মা হাতে হারিকেন নিয়ে পুকুরের পাশেই ধানক্ষেতের আইলের ধারে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তারপর আমি নিজেই ধরা দিয়েছিলাম সেদিন। আমাকে পেয়ে মার সেকি কান্না!
এভাবেই চলতে লাগলো আমার দিন। সত্যি কথা বলতে কী, ছোটবেলা থেকেই আমি মায়ের চেয়ে বাবাকেই প্রধান্য দিতাম বেশি।
আমরা ছিলাম সাত ভাই। কোনো দিন মা কাউকে আলাদা করে দেখতেন না। আজও না। বেশ কয়েক বছর আগে আমার এক ভাই আকস্মিক ভাবে সুপারীর গাছ থেকে পড়ে মারা যান। তখন মা প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। তিন মাস ঘরে বন্দী ছিলেন মা। তখন আমার খুব খারাপ লাগতো।
আমার এস.এস.সি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন সকালে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। আমার দাদা (বড় ভাই) কী একটা কাজ করতে বলেছিলেন সেদিন। কিন্তু আমি কেন যেন জেদ ধরে দাদার মুখের ওপর না করে দিয়েছিলাম। তারপর যা হবার তাই। খাটের স্ট্যান্ড ভেঙ্গে শুরু হলো পিটুনী। সেই সঙ্গে যোগ দিলেন আমার বাবা একটু পর মাও। খুব কষ্ট লেগেছিলো সেদিন। তারপর আবারো ঘর পালানো ছেলের ঘর পালাতে হলো। সারাদিন না খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। বিকেলে এলো ফলাফল প্রকাশের ক্ষণটি। স্কুলের গেটে গিয়েই দেখি আমার বাবা আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি বাবাকে দেখে ঘাপটি মেরে একটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেলাম। বাবার মুখে হাসি কিন্তু চোখে তাঁর দু:খ আর ক্লান্তির ছাপ। একটু পরে বাবা চলে গেলেন। আমি এবার স্কুলে ঢুকে পড়লাম। সবাই কাঁদছে। আমারও ভিষণ কান্না পাচ্ছে। এমনিতে সারাদিন কিচ্ছু খাইনি। মাঠেই স্যারের সঙ্গে দেখা। স্যার জানালেন, স্কুলে একজন ছাড়া আর কেউই পাশ করেনি। আর সেই পাশ করা ছেলেটি ছিলাম আমি। অভিমান আর ধরে রাখতে পারি নি। সঙ্গে সঙ্গেই বাসায় চলে গেলাম। বাসায় পৌঁছেই দেখি মা কাদছেন। আমাকে দেখা মাত্রই তাঁর কান্না যেন কোন অতলে হারিয়ে গেলো। এই হলো আমার মা।
এরপর এলো কলেজে ভর্তির সময়। আমার বাবা চাইতেন শহরের কোনো ভালো কলেজে ভর্তি করাবেন। কিন্তু আমার বড় ভাই মানে দাদা কিছুতেই তাতে রাজী নন। কিন্তু আমিও কম নাছোর বান্দা না । গো ধরে বসলাম বাবার কাছে। বাবা আবার কোনো দিন আমার কোনো চাহিদা অপূর্ণ রাখেন নি। তাই দাদাকে না জানিয়ে আমাকে একটা ভালো কলেজের ভর্তি ফরম এনে দিলেন বাবা। ওই কলেজে সব টাকা ওয়ালা লোকের ছেলে মেয়েরা পড়ে। ঘুষ দিয়ে ভর্তি হতে হয়। তাই বাবার ধারণা ছিলো আমি চাঞ্জ পাবো না। কিন্তু রেজাল্টের দিন আমি একাই চুরি করে শহরে গিয়ে রেজাল্ট দেখতে গিয়ে দেখি আমি মেধা তালিকায় প্রথম হয়েছি। সেদিন পাগলের মতো সাইকেল চালিয়ে বাসায় এসে বাবাকে এই সুখবরটা জানালাম। কিন্তু বাবা মা কেউই এ কথা বিশ্বাস করতে চাইলেন না। পরে মায়ের জেদে বাবা পরদিন সেই স্কুলে গিয়ে রেজাল্ট দেখে আসলেন। কিন্তু তিনি খুব একটা খুশি হতে পারলেন না। কারনটা হলো, দাদা তো আমাকে ওই কলেজে ভর্তি হতে দেবেন না । বাবা যেন আমাকে বলা মুখের সব ভাষাই হারিয়ে ফেলেছেন।
অবশেষে আমার দাদা ঠিকই গ্রামের একটি কলেজে ভর্তি করালেন। কিন্তু আমার মন মানতে পারলো না। মা বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন। এক সময় আমাদের আভিজাত্য থাকলেও সেই সময়টা অর্থনৈতিক ভাবে আমাদের একেবারে করুণ ছিলো। তাই মা আমার দিকে তাকিয়ে ভর্তির একদম শেষ দিনে গলা থেকে সোনার হারটা খুলে দিয়েছিলেন। বাবা না করেছিলেন অনেক। আমি এতে রাজী হতে পারিনি। কিন্তু মাও যেন জেদ ধরে বসলেন। অতপর, মায়ের সেই গলার হার বিক্রি করে আমি সেদিন শহরের ওই ভালো কলেজটিতে ভর্তি হয়েছিলাম। মায়ের গলার হার বেঁচে কলেজে ভর্তি হওয়ার ঘটনা আজও বাবা ছাড়া কেই জানেন না। দাদা অবশ্য এতে একটু মন খারাপ করেছিলো সেদিন। সেদিনই পণ করেছিলাম আমি নিজের উপার্জিত টাকা দিয়ে মায়ের গলার হার বানিয়ে দেবো। যদিও তার কিছুদিন পরেই বাবা আমার মাকে হার বানিয়ে দিয়েছিলেন।
আমার দাদা মানে আমার বড় ভাই আবার সবার মাঝেই বেশ পরিচিত ব্যক্তি। তাই আমার কলেজের শেষ দিনে কলেজে তিনি বক্তব্য দিতে এসেছিলেন তিনি। আমাকে নিয়ে কথা বলতে বলতে কী কারণে যেন, কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি। আজও তা বুঝতে পারিনি। এই হলো আমার মা।
খুবই সাধারণ এক মানুষ। অতি সাধারণ এক মা। যার মুখ আমি সবার মায়ের মুখে বসিয়ে দেখেছি—তাঁকে চিনতে আমার ভুল হয়না, হবেও না কখনো।
মা, অনেক দিন তোমার কাছে যাওয়া হয় নি মা। আমার তো মন প্রতি মুহুর্তে তোমার কাছে ছুটে যায়। কিন্তু এ নিষ্ঠুর নগরী আমাকে বুঝতে পারে না মা। তুমি রাগ করো না মা। তোমার ছেলে তোমার জন্য গলার হার বানিয়েই তবে আসবে। দোয়া কোরো মা।

মা দিবসে সব মায়েদের প্রতি আমার ভালবাসা